কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার আগামী দিনগুলোয় বিশ্ববাসীর জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে, না দুর্ভোগ বাড়াবে- তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে রয়েছে প্রাঞ্জল বিতর্ক। বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতি মানব জীবনে যে প্রশান্তির পরশ বইয়ে দিয়েছে, তা আরও বেগবান হবে; নাকি মানব সভ্যতাকেই কোনো এক অজানা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে- এ নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে।
মেশিন যখন মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা দেখায়, সেটিই তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসেবে বিবেচিত হয়। যুক্তি, সমস্যা সমাধান, মানুষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা, উপলব্ধি, শিক্ষণ, পরিকল্পনা, কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটানো বা কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন মেশিনই হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মেশিন।
এ প্রযুক্তি অনেক সফল ব্যক্তিত্ব তৈরি করবে, আগ্রহ উদ্দীপক ক্যারিয়ারও তৈরি করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বিগ ডাটা বিশ্ব মুক্তির পথ উন্মুক্ত করবে। কারণ ভবিষ্যতে অনেক কিছুই করা হবে মেশিন দিয়ে।
আগামী দিনগুলোয় চিকিৎসাসেবায়, অফিস-আদালতে, শিল্প-কারখানায়, সংবাদসংস্থা বা গণমাধ্যমে, ভাষান্তর প্রক্রিয়ায়, টেলিফোন সেবায়, বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, হোটেল-রেস্তোরাঁ এমনকি বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র তথা রোবটের ব্যাপক ব্যবহারের আভাস দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক. স্বয়ংক্রিয় পরিবহন ব্যবস্থায় দুই. টেকনোলজি- যান্ত্রিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা মস্তিষ্ক দ্বারা চালিত হবে তিন. বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে চার. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানে পাঁচ. বন্ধুভাবাপন্ন রোবট, ছয়. বয়োবৃদ্ধদের উন্নত পরিচর্যায়। জানা যায়, জাপানে ইতিমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সংবাদ মাধ্যম কোম্পানি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেক বড় বড় কোম্পানি তাদের প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দেখভালের বিষয়টি বুদ্ধিমান মেশিনের ওপর ছেড়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
তবে নতুন প্রযুক্তির কারণে ১৩ কোটিরও বেশি কাজের সুযোগের সৃষ্টি হবে। ডাটা এনালিস্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপার, সোশ্যাল মিডিয়া স্পেশালিস্ট এ ধরনের কাজ অনেক বাড়বে। এছাড়া শিক্ষক বা কাস্টমার সার্ভিস কর্মীর মতো কাজ, যাতে কিনা অনেক সুস্পষ্ট মানবিক গুণাবলীর দরকার হয়, সেরকম অনেক কাজও তৈরি হবে।
বোদ্ধামহল মনে করছেন, বুদ্ধিমান মেশিনের এনে দেয়া প্রাচুর্যের ফলে ওই মানবিক কাজের চাহিদা অনেকাংশে বাড়বেই কমবে না। আগামী দিনগুলোয় দাফতরিক কাজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক ব্যবহার এবং কাজের গুণগত মান দুই-ই বাড়বে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুফলের দিক আলোচনা করা যাক। ‘পিং অ্যান’ নামের একটি চীনা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি মনে করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্রে অসততা ধরা যায়। ওই প্রতিষ্ঠানটি তাদের অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকদের ঋণের আবেদন গ্রহণ করে। সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতাদের তাঁদের আয়সহ ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরিকল্পনা বিষয়ে ভিডিওর মাধ্যমে তথ্য দিতে হয়। অ্যাপটি ব্যবহারকারীর ৫০ ধরনের মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে তাদের সত্য-মিথ্যার ধরন নির্ণয় করে। যন্ত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকায় গ্রাহক চিনতে সুবিধা হয়। যাঁদের নিয়ে সন্দেহ হয়, তাদের আরও বেশি যাচাই-বাছাই করা হয়। অর্থাৎ বুদ্ধিমান অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহক বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজ করা যাচ্ছে। শুধু ঋণ গ্রহণ বা আর্থিক খাতেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ? না, তা নয়। কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কর্মীর আবেদনপত্র যাচাই-বাছাইয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সংবাদপত্রেও এখন দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ সাংবাদিকের কাজও করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমান সফটওয়্যার। সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ তাদের অর্থনীতিবিষয়ক প্রতিবেদন তৈরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণ করে তাদের সফটওয়্যার। এ ছাড়া মোবাইল সেবাদাতা ভোডাফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যার পূর্বাভাস দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সাইবার নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ঝুঁকি নির্ণয়েও এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে।
এখন পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে বেশি সুবিধা নিতে পেরেছে প্রযুক্তি খাত। এখনকার শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পশ্চিমাদের গুগল ও আমাজন আর চীনের আলীবাবা ও বাইদুর কথা বলাই যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে সফল হয়েছে তারা। যেমন আমাজনের ক্ষেত্রে রোবটকে নির্দেশ দেওয়া, ভুয়া পণ্য শনাক্ত করা এবং ডিজিটাল সহকারী সফটওয়্যার অ্যালেক্সাতে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আলীবাবাতেও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার দেখা যায়।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর প্রয়োগে ব্যবস্থাপকেরা প্রতিষ্ঠানের কর্মীর ওপরে অকল্পনীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। উদাহরণ চোখের সামনেই। কর্মীদের হাতে পরার উপযোগী একটি ব্যান্ডের পেটেন্ট করিয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান আমাজন। ব্যান্ডটি ওয়্যারহাউসের কর্মীদের হাতের নড়াচড়া শনাক্ত করতে সক্ষম। কর্মীরা যখন বসে থাকবে, তখন এটি ভাইব্রেশন দেওয়া শুরু করবে।
‘ওয়ার্কডে’ নামের আরেকটি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কথা বলা যাক। প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মীর কী মনোভাব তা জানা দরকার? কে কখন চাকরি ছাড়বে, সেটি ধারণা করা লাগবে? নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে সফটওয়্যারটি সে সুবিধা দেয়। ৬০টি বিষয় বিবেচনা করে কৃত্রিম বুদ্ধির প্রয়োগে পূর্বাভাস দিতে পারে ওয়ার্কডে সফটওয়্যার।
এবার আসা যাক ‘হিউম্যানজি’ নামের একটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের কথায়। স্মার্ট আইডি ব্যাজ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। এ ব্যাজ কর্মীদের আচরণ শনাক্ত করতে পারে। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার ধরন বা আচরণের ধরনসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে ওই ব্যাজ। পরে তার ফল জানিয়ে দিতে পারে।
অবশ্য কর্মক্ষেত্রে নজরদারির বিষয়টি একেবারে নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই কর্মীদের ওপর নজরদারি করে আসছে অনেক প্রতিষ্ঠান। কর্মীরা কখন কী করেন, কখন অফিসে আসেন বা কখন বাইরে যান, বিভিন্ন উপায়ে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতনেরা তা জানার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া কর্মীরা কম্পিউটারের বসে কী কাজ করেন, সেটাও তাঁদের অজানা নয়। তাঁদের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তো সোনায় সোহাগা! তাঁদের কাছে কর্মীদের সবকিছু নজরদারি করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিনিয়োগ উপযুক্ত বলে মনে হবে। কারণ, সব তথ্যই তো মূল্যবান! তা ছাড়া কর্মক্ষেত্রে কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তার বিষয়ে আইনকানুন কম। অনেক কর্মীই কাজের চুক্তির আগে অসতর্কভাবেই নজরদারির বিষয়ে সম্মতি দিয়ে দেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে এ সুবিধা কত দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে, তা কখনো ভেবেছেন কি?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরও কিছু সুফলের কথা জেনে রাখুন। প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দিতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ। কারণ, কর্মীদের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কম। কে কী করে, সব তথ্য জানা যায়। স্মার্ট আইডি ব্যাজ প্রস্তুতকারক ‘হিউম্যানজি’র কথা শুনেছেন। এ সফটওয়্যারটি কর্মীর ক্যালেন্ডার বা ই-মেইলের দেওয়া কাজের সঙ্গে ব্যাজের সংগৃহীত তথ্য মেলায়। এরপর তা থেকে অফিসে দলগত কাজের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে ম্যাসেজিংয়ের অ্যাপ ‘স্ল্যাক’-এর কথা তো অনেকেরই জানা। ব্যবস্থাপকদের জন্য দারুণ কাজের সফটওয়্যার এটি। কর্মীদের কাজের গতি মাপার সুযোগ করে দিতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু এ রকম উৎপাদনশীল সফটওয়্যারেই সীমাবদ্ধ নেই। কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত স্ক্রিন ব্যবহার করে ভুয়া খরচের দাবি, ভুয়া রসিদ তৈরি, ভুয়া অতিরিক্ত কাজের পারিশ্রমিক দাবির বিষয়গুলো ধরা যায়।
এতে কি শুধু প্রতিষ্ঠানের লাভ? না, কর্মীদেরও কিছুটা লাভ আছে। কর্মীরা নিয়ম মানছেন কি না, তাঁরা সুস্থ আছেন কি না, তা জানার সুযোগ আছে। কম্পিউটার ভিশন প্রযুক্তিতে কর্মীরা নিরাপদ পোশাক পরেছেন কি না, সেগুলোও পরীক্ষা করা যায়। এতে কর্মীরা নিরাপদ থাকেন। ফলে কাজের জন্য ন্যায্য মূল্যায়ন পাওয়ার আশা থাকে। আবার কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাওয়া যায়। যেমন ‘কোগিটো’ সফটওয়্যারের উদাহরণ আনা যায়। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটি এমন সফটওয়্যার তৈরি করেছে, যা গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে কাজে লাগানো যায়। এটি গ্রাহক সেবাদাতার ফোনকল শুনে সেবাদাতাকে স্কোর দিতে পারে। গ্রাহককে কত দ্রুত ও সফলতার সঙ্গে সেবা দিতে কর্মী সক্ষম হয়েছে, তা ধরতে পারে ওই সফটওয়্যার।
কারও বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্রের সাহায্যে তাঁর পদোন্নতি ও বেতন বাড়ানোর বিষয়টি ঠিক করা যায়। পুরো পদ্ধতিটি তাঁকে নিয়োগ দেওয়ার সময় থেকেই শুরু হতে পারে। মানুষের ক্ষেত্রে পক্ষপাত থাকতে পারে কিন্তু অ্যালগরিদম যদি নিখুঁতভাবে তৈরি করা যায়, তা কখনো পক্ষপাত করে না।
মানুষ যে ভুলগুলো করে সফটওয়্যারে তা সম্ভব নয়। ‘টেক্সটিও’ নামের একটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের কথা বলা যায়। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়েছে, যা চাকরির বর্ণনাকে এমনভাবে উন্নত করে, যাতে নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করানো যায়। এ ছাড়া অ্যালগরিদম ব্যবহার করে বৈষম্য ধরা সহজ হয়।
গোলাপে যেমন কাঁটা থাকে, তেমনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কিছু কুফল আছে। এতক্ষণ যে সুফলের কথা বলা হলে, এর বিপরীতেই সম্ভাব্য কিছু নেতিবাচক দিকের কথাও জেনে রাখা ভালো। মনে রাখতে হবে, এই সফটওয়্যার বা প্রোগ্রামগুলো মানুষের তৈরি। তাই এগুলো প্রোগ্রামারের ইচ্ছা অনুযায়ী পক্ষপাত দেখাতে পারে।
০ টি মন্তব্য