স্মার্ট পদ্মা সেতু সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর
প্রমত্তা পদ্মার দুই কূল এক করে দিয়েছে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু। নকশা প্রণয়ন, নদীশাসন থেকে শুরু করে এর যাবতীয় ব্যবস্থাপনা সব ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এ কারণেই সেতুটি হয়ে উঠেছে নান্দনিক ও টেকসই। অন্যদিকে এমন খরস্রোতা নদীতে এ ধরনের সেতু নির্মাণ বিশ্বের কাছেও রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ এই সেতু নির্মাণে ৫টি বিশ্বরেকর্ড গড়েছে, যা এর আগে কোনো সেতুতে ব্যবহার করা হয়নি। এ ধরনের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মূলত প্রমত্তা পদ্মার বুকে অত্যাধুনিক সেতু গড়ে তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৩ ধরনের প্রযুক্তি। স্মার্ট সেন্সর, স্যাটেলাইট, জিপিএস, পেন্ডুলাম বিয়ারিংসহ সেতু নির্মাণে প্রতিটি পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়েছে নানা প্রযুক্তি ও ডিভাইস। ২৫ জুন উদ্বোধন হওয়া পদ্মা সেতুর টোল আদায়েও ব্যবহার হয়েছে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি। মূল অবকাঠামোর পাশাপাশি নিরাপত্তায় পদ্মা সেতুতে রয়েছে অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা।
প্রচলিত ব্রিজে কোথাও ফাটল কিংবা অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা তা ম্যানুয়ালি পর্যবেক্ষণ করা হয়। পর্যবেক্ষণে এ রকম কিছু ধরা পড়লে তা ঠিকঠাক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে পদ্মা সেতুকে বলা হচ্ছে স্মার্ট সেতু। কেননা সেতুটির বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো হয়েছে স্মার্ট সেন্সরভিত্তিক গেজেট। এ সেন্সরগুলো সার্বক্ষণিক সেতুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবে। একে বলা হচ্ছে সেতুর ‘হেলথ মনিটরিং সিস্টেম’। কোনো কারণে সেতুর কোনো অংশে ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিক জানিয়ে দেবে এ সেন্সর। সেতু রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বরতদের কমপিউটার সিস্টেমে ভেসে উঠবে তাৎক্ষণিক সতর্ক বার্তা। আর এটি দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবেন প্রকৗশলীরা। বিশেষ করে ভূমিকম্প কিংবা এ ধরনের বড় কোনো দুর্যোগে সেতুর স্টিলের ট্রাস বেঁকে যেতে পারে, ভেতরে ভেঙে যেতে পারে, সাব-স্ট্রাকচার কিংবা সুপার স্ট্রাকচারের ক্ষতি হতে পারে, পিলারের ক্ষতি হতে পারে, বিয়ারিংয়ের ক্ষতি হতে পারে, ট্রাসের ক্ষতি হতে পারে, ডেকের ক্ষতি হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এসব ছোট সমস্যা থেকে বড় সমস্যা হওয়ার শঙ্কা থাকলেও সেটি জানিয়ে দেবে এ সেন্সর। এতে ক্ষতি এড়াতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। সেতুর এ স্মার্ট ফিচারটি সেতু রক্ষণাবেক্ষণে তাৎক্ষণিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় এ ফিচার সেতুর জীবনকাল নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দেবে।
অন্যদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণে জটিল প্রক্রিয়া পার হতে হয়েছে নদীশাসন অংশে। শত শত বছর ধরে বাধাহীন প্রবহমান নদীকে পদ্মা সেতু নির্মাণবান্ধব করতে নানা কারিগরি প্রযুক্তি সংযুক্ত করতে হয়েছে। বেপরোয়া চঞ্চল নদীকে বশে আনতে এ কাজে ব্যবহার হয়েছে প্রযুক্তি। নদীশাসনে ‘গাইড ব্যান্ডউইথ ফলিং অ্যাপ্রোন’ কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। নদীর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে স্যাটেলাইট খুবই কার্যকর প্রযুক্তি। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যেকোনো নদীর কাঠামোগত মানচিত্র জানা যায়। তবে সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ছিল স্যাটেলাইট মানচিত্রের বিস্তারিত তথ্য। সুইজারল্যান্ড স্যাটেলাইট মানচিত্র থেকে বিস্তারিত নিয়ে কাজ শুরু করে সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সেতুর নকশা প্রণয়নে নদীর গতিপথ বদলানোর চিত্রে স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বহুরূপী পদ্মার গতিপথ আর চরিত্র নির্ণয়ে জিপিএসের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে। নদীশাসন আর পাইলিংয়ের কাজে ব্যবহার হয়েছে জিপিএস প্রযুক্তি। নদীর পাড়ে যে বৃহৎ আকৃতির পাথর ও জিওব্যাগ বসানো হয়েছে, সেগুলো জিপিএসের মাধ্যমে হিসাব-নিকাশ করে বসানো হয়েছে।
ভূমিকম্প প্রতিরোধে পদ্মা সেতুতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেন্ডুলার বিয়ারিং (এফপিবি) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। স্টিল সুপার স্ট্রাকচার ও কংক্রিটের ফাউন্ডেশনের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের কাজটি করেছে এই ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং। এই বিয়ারিং থাকার ফলে নদীর তলদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্পন হলেও এর পুরো মাত্রা সেতুর স্টিলের সুপার স্ট্রাকচারে যাবে না। ফলে ব্রিজটি বর্ধিত মাত্রার ভূমিকম্পও সহ্য করতে পারবে। সেতু কর্তৃপক্ষ বলেছে, পদ্মা সেতুটি রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আর ভূমিকম্প প্রতিরোধে অন্যতম ভূমিকা রাখবে এই দোদুল্যমান বিয়ারিং। সাধারণত প্রচলিত কংক্রিটের ব্রিজ জীবনকাল শেষ হয়ে গেলে একে পুনর্ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু পদ্মা সেতু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এটি স্টিলের ট্রাস ব্রিজ। তবে সড়কে এবং রেলপথেও আছে কংক্রিটের ব্যবহার। ফলে একে বলা হচ্ছে কম্পোজিট ব্রিজ। এটি শতভাগ ওয়েল্ডেড বা ঝালাই করা। স্টিলের ব্রিজের বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি কংক্রিটের চেয়ে অনেক হালকা ব্রিজ। জীবনকাল শেষ হলে একে পুনর্ব্যবহার করা যাবে এবং এটি পরিবেশবান্ধব।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সহজেই অপেক্ষাকৃত কম খরচে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাবে। কুয়াকাটায় অবস্থিত ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ ছড়িয়ে পড়ে। তবে পদ্মা সেতু হওয়ায় বিকল্প সংযোগ স্থাপন সহজ হবে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কানেকটিভিটির দূরত্বও কমে যাবে। এর ফলে ইন্টারনেটের গতি বাড়বে। পাশাপাশি গুগলের ম্যাপিং অ্যাপ্লিকেশন গুগল ম্যাপেও দেখা যাচ্ছে পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুসংলগ্ন রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা চলে এসেছে গুগল ম্যাপে। স্যাটেলাইট ভিউতেও দেখা যাচ্ছে সেতুটি। ফলে সেতুর রুট ম্যাপ, সেতুর ওপর যানবাহনের অবস্থা জানা যাবে।
পদ্মা হচ্ছে আমাজনের পর পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদী। বিশ্বের এই বৃহত্তম ডেল্টার মাঝামাঝি এসে বিশাল যমুনা মিশেছে প্রমত্তা পদ্মার সাথে। তৈরি করেছে স্রোতস্বিনী এক বিশাল জলরাশির, যা দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে আলাদা করে রেখেছে এর উত্তর-পূর্বে অবস্থিত রাজধানী ও প্রধান সমুদ্রবন্দর থেকে। তাই সড়কপথে যাতায়াতে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে প্রতিনিয়ত নদী পাড়ি দিতে হয়।
এ কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলাকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করতে প্রায় এসব অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পদ্মার দুই পাড়ের মধ্যে সেতুবন্ধের। এসব মানুষের দাবি পূরণে সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য সমীক্ষার পর সেতু ডিজাইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘মুনসেল এ কম জে ভি’কে নিয়োগ দেয়। সেতু ডিজাইনের ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর তিনটি বৈশিষ্ট্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। সদা পরিবর্তিত পদ্মার মূল স্রোতধারা, প্রচুর পলিবাহিত পদ্মার তলদেশে তীব্র স্রোত এবং পদ্মার তীর ভাঙন।
পরিবেশ রক্ষায় প্রকল্প এলাকায় বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় ৯০-এর অধিক প্রজাতির প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজারের অধিক ফলদ ও বনজ বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। একই সাথে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল সংরক্ষণের জন্য এলাকাকে সরকার থেকে পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া এলাকার জীববৈচিত্র্যের ইতিহাস ও নমুনা সংরক্ষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি অস্থায়ী জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
প্রমত্তা পদ্মাকে শাসন করতে সর্বশেষ প্রযুক্তির প্রকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। এর নাম ‘গাইড ব্যান্ডউইথ ফলিং অ্যাপ্রোন’। এ প্রকৌশলে আধুনিক ড্রেজার ব্যবহার করে ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত খনন করে ঢাল তৈরি করা হয়। প্রকৌশলবিদদের মতে, ড্রেজার দিয়ে স্টিল আর কংক্রিটের তৈরি দ্বিতল বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণকালে সর্বাধুনিক ড্রেজার ব্যবহার করে খনন করা যেত সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ১৮ মিটার। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ মিটারে।
সহজে নদীর গতিপথ ও স্বভাব নির্ধারণ করতে নদীশাসনের সময় নদীর পাড়ে যে পাথর বসানো হয়, সেগুলো সম্পূর্ণভাবে জিপিএস দিয়ে হিসাব করে বসানো হয়েছে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে নদীশাসনে আর পাইলিংয়ের কাজে জিপিএস প্রকৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি সেতুর ডিজাইনের সময় নদীর গতিপথ পরিবর্তনের চিত্র স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে বানানো হয়েছে।
পাইলিংয়ের জন্য পদ্মা সেতুতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। সেই প্রযুক্তি দিয়েই পদ্মায় পাইলিং খনন করা হয়েছে প্রায় ১২২ মিটার। এটি নদীতে সেতুর কাঠামো নির্মাণে বিশ্বের গভীরতম পাইলিং। এটি প্রায় ৪০তলা বিল্ডিংয়ের উচ্চতার সমান। এখানে ৩ মিটার ব্যাসের ইস্পাতের টিউবকে কিছুটা বাঁকাভাবে হ্যামার দিয়ে মাটিতে ঢোকানো হয়েছে।
পাইলিংয়ের উপরিভাগে স্ক্রিন গ্রাউটিং করে অতিমিহি সিমেন্টের স্তর পাইলের ওজন বহন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। পিলার এবং স্টিলের কাঠামোর সংযোগস্থলে ১০০ টনের বিয়ারিং বসানো হয়েছে। সাধারণত সেতুতে দুটি করে বিয়ারিং বসানো হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুতে দুই স্প্যানের সংযোগ স্থলে তিনটি করে বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে।
ডিজাইন অনুসারে পদ্মা সেতু প্রায় ১০ হাজার টন লোড সামলাতে সক্ষম। কিন্তু বিশ্বে এ ধরনের পরীক্ষায় মাত্র ৮ হাজার টন লোডের জন্য পরীক্ষা করা যায়। বাকি অংশ স্কেল মডেলে পরীক্ষা করা হবে। এফপিবি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রায় ১০ কোটি মার্কিন ডলার কমে গেছে। এটি ব্যবহার না করলে প্রতি পিলারে ৬টির পরিবর্তে ৮টি করে পাইলিং করতে হতো। মূলত বিল্ডিংয়ের ভার বহন, কাঠামোর চাপে যাতে মাটি সরে না যায় এবং ক্ষয় না হয়ে যায় সে কারণে পাইলিং করা হয়।
মূল অবকাঠামোর পাশাপাশি পদ্মা সেতুতে রয়েছে অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা। সাধারণ আলোক সুবিধার পাশাপাশি সেতুতে রয়েছে আলোকসজ্জা এবং সৌন্দর্যবর্ধনে রয়েছে আর্কিটেকচার লাইটিং। স্বয়ংক্রিয় টোল আদায়ে ব্যবহার হয়েছে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন। সেতুর দুই প্রান্তে বসানো হয়েছে মোট ১৪টি ইলেকট্রনিকস টোল কালেকশন (ইটিসি) বুথ। সেতুতে রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পরিবহন সুবিধা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
ফিডব্যাক : [email protected]
০ টি মন্তব্য