https://www.brandellaltd.com/

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব

২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব
 

২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব


স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি এবং উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ ভিশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ গঠিত হয়।


এটি বাস্তবায়ন করছে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলা এবং পিছিয়ে পড়া 


প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভারনারেবল এক্সেপশন (ডাইভ) উদ্যোগের আওতায় আত্মকর্মসংস্থানভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ। বাস্তবায়নের দায়িত্ব তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের।


শিক্ষার্থীদের অনলাইন কার্যক্রম নিশ্চিতে ‘ওয়ান স্টুডেন্ট, ওয়ান ল্যাপটপ, ওয়ান ড্রিম’-এর আওতায় শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যা বাস্তবায়ন করবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।


স্মার্ট ও সর্বত্র বিরাজমান সরকার গড়ে তুলতে ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি স্থাপন। বাস্তবায়ন করবে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। ক্ষুদ্র, কুটির, ছোট, মাঝারি ব্যবসাগুলোর জিডিপিতে অবদান বাড়াতে এন্টারপ্রাইজভিত্তিক ব্যবসাগুলোকে বিনিয়োগ উপযোগী স্টার্টআপ হিসেবে প্রস্তুত করা। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। অল্টারনেটিভ স্কুল ফর স্টার্টআপ এডুকেটরস অব টুমরো (এসেট) প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল এটি বাস্তবায়ন করবে। বাংলাদেশ নলেজ ডেভেলপমেন্ট পার্ক নির্মাণ ও পরিচালনা। এটি বাস্তবায়নে থাকছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। সেন্টার ফর লার্নিং ইনোভেশন অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব নলেজ (ক্লিক) স্থাপন। বাস্তবায়নে থাকছে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল। এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) প্রতিষ্ঠা। বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। সেলফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিওরশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিড) প্ল্যাটফর্ম স্থাপন। এটি বাস্তবায়ন করবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। কনটেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লিংকেজ ল্যাব (সেল) স্থাপন। তথ্যপ্রযুক্তি অধিদপ্তর এটি বাস্তবায়ন করবে। সার্ভিস এগ্রিগ্রেটর ট্রেনিং (স্যাট) মডেলে সরকারি সেবা ও অবকাঠামোনির্ভর উদ্যোক্তা তৈরি করা। বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল।


সব ডিজিটাল সেবাকে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ক্লাউডে নিয়ে আসা। এটি বাস্তবায়নে থাকবে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ডাটা নিরাপত্তা আইন, ডিজিটাল সার্ভিস আইন, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফন্ট্রিয়ার টেকনোলজি (শিফট) আইন, ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিওরশিপ অ্যাকাডেমি (আইডিয়া) আইন, এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) আইন, ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি আইন ও জাতীয় স্টার্টআপ পলিসি প্রণয়ন। এ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।


এর আগে এই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের’ তৃতীয় সভায় স্মার্ট বাংলাদেশের একটি কৌশলপত্র বা রূপরেখা তৈরির কথা বলেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ 


টাস্কফোর্সের বৈঠকে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার পরামর্শ এবং নির্দেশনায় স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির জন্য কাজ চলছে।


উদ্যোক্তা তৈরি এবং জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানি গড়ে তুলতে বিশ্বের স্বনামধন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের বিজনেস ইনকিউবেটর থাকলেও বাংলাদেশে তা এবারই প্রথম। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আইডিয়াগুলো বাস্তবায়ন এবং একজন উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ-অবকাঠামো সহায়তা দেওয়া হবে। এ ইনকিউবেটরের মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রি এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে একটা সেতুবন্ধ  তৈরি হবে।


বলা হচ্ছে, ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার, তা বাস্তবায়নে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরের মতো অবকাঠামো অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। আগামীর তরুণ প্রজন্মের মেধা, বুদ্ধি ও জ্ঞানের বিকাশকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর।


ইনকিউবেটরে বিটিসিএলের মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। ইনকিউবেশন ভবনে একটি স্টার্টআপ জোন, ইনোভেশন জোন, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিক জোন, ব্রেইনস্টর্মিং জোন, একটি এক্সিবিশন সেন্টার, একটি ই-লাইব্রেরি জোন, একটি ডাটা সেন্টার, রিসার্চ ল্যাব, ভিডিও কনফারেন্সিং রুম এবং একটি কনফারেন্স রুম রয়েছে। রফতানি  ক্ষেত্রে এটাই হবে সবথেকে বড় পণ্য, যা আমরা রফতানি করে অনেক  বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। ৪ দশমিক ৭ একর জায়গার ওপর নির্মিত এই স্থাপনা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রচারাভিযান থেকে দেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরের নতুন ধাপ। 


ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প-২০২১ আজ বাস্তবতা। এরই ধারাবাহিকতায় জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আইসিটি বিভাগ ও আওতাধীন সংস্থাসমূহ দৃঢ়প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতেও সক্ষম হয়েছে। প্রতি বছর ১২ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠানকে অনুপ্রেরণা, উৎসাহ ও উদ্দীপনা  জোগান এবং স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কারে ভূষিত করার লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার নীতিমালা ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে।


১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বর্তমানে হাইটেক পার্কের সংখ্যা ৩৯টি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুঠোফোনের একচেটিয়া বাণিজ্য ভেঙে তা মানুষের কাছে সহজলভ্য করেন। ২০১৫ সালে কমপিউটার আমদানিতে শুল্ক হ্রাস, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার শিল্প উৎপাদনকারীদের ভর্তুকি, প্রণোদনা প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সরকারের বিভিন্ন নীতি-সহায়তার ফলে বর্তমানে দেশে হাইটেক পার্কসহ বিভিন্ন স্থানে স্যামসাং, ওয়ালটন, সিম্ফোনি, মাই ফোন, শাওমিসহ দেশি-বিদেশি ১৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মুঠোফোন ও ল্যাপটপ উৎপাদন করছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে এবং দেশের মুঠোফোন চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ করছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব লাভ করার আগে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতি এমবিপিএস ৬০ টাকা।


জনগণের দোরগোড়ায় সহজে, দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে  দেশের ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়নে একযোগে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র উদ্বোধন করেন, যা বর্তমানে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) নামে সুপরিচিত। এই সেন্টার থেকে গ্রামীণ জনপদের মানুষ খুব সহজেই তাদের বাড়ির কাছে পরিচিত পরিবেশে জীবন ও জীবিকাভিত্তিক তথ্য ও প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন। বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ২৮০টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ৩০০-এর অধিক ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা জনগণ গ্রহণ করতে পারছেন। দেশে বর্তমানে মুঠোফোন সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটির অধিক। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বর্তমানে প্রায় ১৩ কোটি। ফোর টায়ার ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার প্রকল্পের আওতায় দেশে একটি সমন্বিত ও বিশ্বমানের ডাটা সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে।  


বিশ্বের ১৯৪টি দেশের সাইবার নিরাপত্তায় গৃহীত আইনি ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সাংগঠনিক ব্যবস্থা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা সূচকে বাংলাদেশ আইটিইউতে ৫৩তম স্থানে এবং এনসিএসআই বা জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা সূচকে ৩৭তম স্থানে অবস্থান করছে। যার ফলে দক্ষিণ এশিয়া ও সার্ক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। ৫২ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইটের জাতীয় তথ্য বাতায়নে যুক্ত রয়েছে ৯৫ লাখেরও অধিক বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট এবং ৬৮৫টির বেশি ই-সেবা সহজেই মানুষ অনলাইনে পাচ্ছেন। ৮ হাজার ২৮টি ডিজিটাল সেন্টার থেকে ৬০ কোটির অধিক এবং জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এর মাধ্যমে ৭ কোটির বেশি সেবা দেয়া হয়। ডিজিটাল সেন্টার, জাতীয় তথ্য বাতায়ন ও মাইগভ থেকে প্রতি মাসে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ৭৫ লাখ।


ডিজিটাল অর্থনীতির ক্ষেত্রেও দেশে ইতিবাচক ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আইসিটি রফতানি ২০১৮ সালেই ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে আইসিটি খাতে রফতানি ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সারের আউটসোর্সিং খাত থেকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। ৩৯টি হাইটেক বা আইটি পার্কের মধ্যে ইতোমধ্যে নির্মিত ৯টিতে দেশি-বিদেশি ১৬৬টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে বিনিয়োগ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং কর্মসংস্থান হয়েছে ২১ হাজার, মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়েছে ৩২ হাজার। নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ হাজার ৫০০ নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ স্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবের সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগযুক্ত ওয়ালটন ট্যাব ব্যবহার করে গণনাকারীর কাছে তথ্য দেয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪টি মাইলস্টোন দিয়েছেন। প্রথম ২০২১ সালের রূপকল্প ডিজিটাল বাংলাদেশ, যা আজ অর্জন করে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, দ্বিতীয় ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, তৃতীয় ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ সালের জন্য। সরকারের বর্তমান লক্ষ্য ২০২৫ সালে আইসিটি রফতানি ৫ বিলিয়ন ডলার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান ৩০ লাখে উন্নীত এবং সরকারি সেবার শতভাগ অনলাইনে পাওয়া নিশ্চিত করা। আরও ৩০০ স্কুল অব ফিউচার ও ১ লাখ ৯ হাজার ওয়াই-ফাই কানেকটিভিটি, ভিলেজ ডিজিটাল সেন্টার এবং ২৫ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তরুণ বয়সে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন আর্কিটেক্ট অব ডিজিটাল বাংলাদেশ সজীব ওয়াজেদ জয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের যে ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, সে পথ ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এক যুগের বেশি পথচলায় প্রমাণিত হয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনার এক উন্নয়ন দর্শন।


বর্তমানে আমরা অবিশ্বাস্য পদ্ধতিগত মৌলিক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি। এই পরিবর্তন ঘটছে প্রচলিত ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তরের পথ ধরে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাবে ক্ষিপ্রগতিতে ঘটছে ডিজিটাল রূপান্তরধর্মী এ পরিবর্তন। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশেও অনলাইনে ক্রয়াদেশে বার্গার, পিৎজা বাসায় সরবরাহ করতে দেখা যাচ্ছে। আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে দেখা যাবে আপনার থ্রিডি প্রিন্টার থেকে তা প্রিন্ট করে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। পদ্ধতিগত এই মৌলিক পরিবর্তনে চ্যালেঞ্জ থাকলেও অবশ্যম্ভাবীভাবে তা সেসব দেশের জন্য কোনো বিপদ বয়ে আনবে না, যারা ডিজিটাল রূপান্তরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দক্ষতার উন্নয়ন করবে। যারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে সৃষ্ট নজিরবিহীন সুযোগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সুপরিকল্পিত কার্যক্রম, নীতি ও কৌশলের বাস্তবায়ন করবে। এক্ষেত্রে 


আমাদের ইতিবাচক দিক হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী ‘রূপকল্প ২০২১’-এর মূল উপজীব্য ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাফল্য। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে শক্তি, সাহস ও প্রেরণা জোগাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। আর তাই দেখা যাচ্ছে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইন্টারনেট অব থিংসের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যা ইতোমধ্যে অর্থনীতির দ্রুত বিকাশে অবদান রাখতে শুরু করেছে। তার ব্যাপক ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে উচ্চাভিলাষী ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ রূপকল্প। কেমন হবে ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ? সমালোচকরা হয়তো বলবেন, অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। ১৩ বছর আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণার পর এমন একটি উচ্চাভিলাষী আধুনিক কর্মসূচির বাস্তবায়ন ‘অসম্ভব’ বা ‘কঠিন হবে’ এমন অনেক কথাই শোনা গিয়েছিল। সরকারদলীয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে সমালোচনাও ছিল প্রবল। কিন্তু সব সমালোচনাকে ছাপিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা। এই সাফল্য থেকে একটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। আর তা হলো, দেশ ও মানুষের কল্যাণে গৃহীত কর্মসূচি যত উচ্চাভিলাষীই হোক; লক্ষ্য স্থির রেখে তা বাস্তবায়নে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে আমরা ডিজিটাল অর্থনীতি নামক নতুন একটি খাত 


পেয়েছি। প্রত্যক্ষ করেছি মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রেরণ। আর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ রূপকল্পের বাস্তবায়নে হয়তো দেখা যাবে স্পেস অর্থনীতি নামক আরেকটি খাত। শুধু স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ রূপকল্পেই নয়; এর আগে ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০৪১’-এও স্পেস অর্থনীতি গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। স্পেস অর্থনীতি গড়ে তোলার পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানাতে হয় দুটি কারণে। তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণে মহাকাশে বাংলাদেশকে আরও বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে হবে। স্যাটেলাইটে বিনিয়োগ লাভজনক। যুক্তরাজ্যের ‘স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনস : উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ১ পাউন্ড ব্যয় করে ৪৫ পাউন্ড আয় করা সম্ভব।


বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর অভীষ্ট অর্জন দ্রুততর করতেই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ রূপকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এর ভিত্তিমূলে রয়েছে দুটি প্রধান অভীষ্ট। প্রথমত, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে বর্তমান মূল্যে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার এবং যা হবে ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীতের ঘটনা। প্রেক্ষিত পরিকল্পনার এই লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করতেই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ রূপকল্পে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। কারণ, আগের তিনটি শিল্পবিপ্লবের চেয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বিশ্বে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। সরকার এসব প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার করে ২০৪১ সালের মধ্যে জাতীয় 


অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আইসিটি খাতের অবদান ২০ শতাংশের বেশি নিশ্চিত করতে চায়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যমতে জ্বালানি, পরিবহন, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ এবং ডিজিটাল উৎপাদন এই পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্র দক্ষতার সাথে পরিচালিত হবে। লক্ষণীয়, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১'’ রূপকল্পে এর চেয়েও বেশি ক্ষেত্রগুলোকে দক্ষতার দ্বারা পরিচালনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আওতায় কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বাণিজ্য, পরিবহন, পরিবেশ, শক্তি ও সম্পদ, অবকাঠামো, বাণিজ্য, গভর্ন্যান্স, আর্থিক লেনদেন, সাপ্লাই চেইন, নিরাপত্তা, এন্টারপ্রেনিওরশিপ, কমিউনিটির মতো খাত প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত হবে এবং প্রতিটি খাত হবে স্মার্ট। যেমন স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট শিক্ষা ইত্যাদি।


বহুমাত্রিক পরিকল্পনা-কর্মকৌশল গ্রহণ ও সফল গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন তথ্যসূত্রে দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবনের পথ ধরে আসা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিজয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বর্তমান সরকার বহুমাত্রিক পরিকল্পনা-কর্মকৌশল গ্রহণ ও সফল বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে সরকারের প্রতিশ্রুতি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। ৭ এপ্রিল ২০২২ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’-এর তৃতীয় সভায় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ভিশন বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশনা দিয়েছেন।


তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে সরকার ২০২১ সালে দেশে ৫জি ইন্টারনেট সেবা চালু এবং একই বছর হাওর-বিল-চর ও পার্বত্য অঞ্চলে ক্যাবল বা স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে। ২০২৩ সালে সংযুক্ত হবে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল। মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিস্তার ঘটছে ইন্টারনেটের সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোগের মাধ্যমে। সংশ্লিষ্টদের মতে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা তার পরবর্তী সময়কে দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করতে ডিজিটাল সংযুক্তির জন্য যতটুকু প্রস্তুতির প্রয়োজন, সরকার তার অধিকাংশই সুসম্পন্ন করেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী সৃষ্টি এবং পরিবেশ সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার ধীরে ধীরে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। 


বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ, এনএসসি ফেলোশিপ এবং বিশেষ গবেষণা অনুদানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দক্ষ মানবশক্তি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে সে লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা এবং গবেষণা খাতে আরও বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষের দেয়া রাজস্ব থেকে আপনাদের ফেলোশিপ এবং গবেষণা অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। যারা ফেলোশিপ পাচ্ছেন, সর্বোচ্চ দায়বদ্ধতা নিয়ে জাতীয় উন্নয়নে কাজ করতে হবে। কারণ, আমরা চাই দক্ষ মানবশক্তি গড়ে তুলতে। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন, তার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ করে উন্নত করতে হবে। পাশাপাশি শিল্পায়নও আমাদের দরকার। আর শিল্পায়নের ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, সেটা আমাদের ধরা দরকার। তার উপযুক্ত দক্ষ মানবসম্পদও আমাদের গড়ে তুলতে হবে।’ তিনি আগামী দিনের বাংলাদেশ বা একচল্লিশের উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজে সকলকে নিবিড় মনোনিবেশ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। 


১১ নভেম্বর ২০২১ ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন ইনফরমেশন টেকনোলজির মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সে প্রদত্ত মূল বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে নেতৃত্ব দিতে সবাইকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা আছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লকচেইন, আইওটি, ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবটিকস, মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইনের মতো ক্ষেত্রগুলোতে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। একসাথে উদ্ভাবনের পথে একযোগে কাজ করতে হবে, তাহলেই আমরা এগিয়ে যাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশে ৩৯টি হাইটেক পার্ক করা হয়েছে। এসব পার্কে বিনিয়োগে কর অব্যাহতি, বিদেশিদের জন্য শতভাগ মালিকানার নিশ্চয়তা, আয়কর অব্যাহতিসহ নানা সুযোগ রাখা হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অনেক ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে। যারা ফ্যাক্টরি বা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে তৈরি অবকাঠামো সুবিধা নিতে চান, তারা এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন।’ তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে চায়না বা ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশের তৈরি মোবাইল হ্যান্ডসেট, হার্ডড্রাইভে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখা যাবে এবং আইটি শিল্প রপ্তানি এক সময় পোশাক খাতকে ছাড়িয়ে যাবে।


এটি সর্বজনবিদিত যে, আঠারো শতকের শেষার্ধে শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল; তার মূলে ছিল এই শিল্পবিপ্লব। এর ফলে ইংল্যান্ড বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত রাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশটির সমৃদ্ধির ভিত রচিত হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। পরবর্তীকালে ইউরোপ ও পশ্চিমা জগতের অনেক রাষ্ট্র শিল্পোন্নত হলেও এ অগ্রগতি বৈপ্লবিক আকার ধারণ করতে সক্ষম হয়নি।


মূলত বাষ্প ও জলশক্তি ব্যবহার করে হস্তচালিত শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থাকে মেশিনচালিত পদ্ধতিতে রূপান্তরের মাধ্যমে প্রথম শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছিল। ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে রেলপথ ও টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্কের ব্যাপক বিস্তারের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব বা প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সূচনা ঘটেছিল যা মানুষ এবং চিন্তাভাবনার দ্রুততার স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি করেছিল। এটি ছিল উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে দুর্দান্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময়। এই বিপ্লবের মূল আবিষ্কার ছিল বিদ্যুৎ।


বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে দুটি বিশ্বযুদ্ধের শেষে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির চলমান শিথিলতায় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব তথা ডিজিটাল বিপ্লবের উন্মেষ। এর প্রায় এক দশক পরে আসে ফ্লোটিং-পয়েন্ট নাম্বার এবং বুলিয়ান লজিক ব্যবহার করে হিসাব-নিকাশে সক্ষম জেড ওয়ান কমপিউটার। যোগাযোগ প্রযুক্তিতে পরবর্তী উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হচ্ছে সুপার কমপিউটার।


ইন্টারনেটের উদ্ভবে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। উন্নত দৈশের জনগণ প্রথমে তারযুক্ত টেলিফোন ও বেতার ফোনের পর্যায়ে অগ্রসর হলেও মোবাইল প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ মানুষ সরাসরি মোবাইল ফোনের জগতে প্রবেশ করে। স্মার্ট মোবাইল ফোন আবিষ্কারের ফলে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ সম্ভব হয়েছে। উক্ত সময়ে উৎপাদন প্রক্রিয়াতে কম্পিউটার এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারে আধুনিক যন্ত্রপাতি দীর্ঘ সময় প্রচলিত মানবশক্তির অবস্থানকে দখলে নেয়।


ডিজিটাল বিপ্লবের আশীর্বাদে উৎপাদন ব্যবস্থায় কল্পনাতীত পরিবর্তন প্রত্যাশিত। উৎপাদনের জন্য মানুষকে যন্ত্র চালানোর পরিবর্তে যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরও নিখুঁত ও নির্ভুল কর্ম-সম্পাদন করার ভিত্তি রচনা করবে। পাশাপাশি চিকিৎসা, যোগাযোগ, প্রকাশনা ইত্যাদি খাতে এর দৃশ্যমান প্রভাব অধিকতর জোরালো হবে। শোয়াব ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগাম ফসল হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০ শতাংশ মানুষের পরিধেয় বস্ত্র এবং চশমার সাথে সংযুক্ত থাকবে ইন্টারনেট।


মানুষের শরীরে পাওয়া যাবে স্থাপনযোগ্য মোবাইল ফোন। ৯০ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করবে। আমেরিকার ১০ শতাংশ গাড়ি হবে চালকবিহীন। ৩০ শতাংশ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অডিট হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অডিটর দিয়ে। এমনকি কোম্পানির বোর্ডের একজন পরিচালক হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট।  


চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে সৃষ্ট নতুন সম্ভাবনার বিপরীতে তৈরি হয়েছে নানাবিধ ঝুঁকি বা প্রতিবন্ধকতা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের দাবি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ চাকরি হারাতে পারে। প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে প্রায় মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ কর্মহীন হতে পারে। একটি যন্ত্র সম্ভাব্যভাবে ১০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়মিত শ্রমিকের পরিবর্তে অনিয়মিত শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে।


মূলত শ্রমঘন শিল্প স্থাপন এবং উৎপাদিত সামগ্রী ‘অব-শোরিং’ প্রক্রিয়ায় উন্নত বিশ্বে রপ্তানির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশসমূহ উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের ব্যবহারে উৎপাদনে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস ও শ্রম বাবদ খরচ সাশ্রয়ে সেসব উৎপাদন প্রক্রিয়া নতুন করে উন্নত দেশে ফিরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ উন্নয়নশীল বিশ্বকে প্রচণ্ড হুমকির সম্মুখীন করবে। এই বিপ্লবের অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে উচ্চ ব্যয়, উপযুক্ত ব্যবসায়িক মডেলের সাথে খাপ খাওয়ানো, অস্পষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা ও অতিরিক্ত বিনিয়োগ।


ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগ, নজরদারি ও অবিশ্বাস তৈরি, সামাজিক বৈষম্য এবং অস্থিরতা বৃদ্ধিও অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিকভাবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সামগ্রিক দলীয় শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ন রাখার কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্যতা সৃষ্টিসহ আরও অগণিত প্রতিবন্ধকতার দুর্ভেদ্য প্রাচীর নির্মাণের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাব্য সঙ্কটসমূহ যথার্থ অনুধাবনে সময়োপযোগী কর্ম-পরিকল্পনা ও দৃশ্যমান বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় গ্রহণ সরকারকে বিপুল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবেই। এ ধরনের বস্তুসত্যনিষ্ঠ উপলব্ধির ভিত্তিতে জনগণের কাক্সিক্ষত প্রত্যাশা ব্যক্ত করা মোটেও অমূলক-অযৌক্তিক নয়।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ করব। সম্প্রতি চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’ উদ্বোধন করে একথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি আরও বলেন, নিজেরাই দেশে ডিজিটাল ডিভাইস তৈরি করে বিদেশে রফতানি করা হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে গড়ে তোলা হবে স্মার্ট বাংলাদেশ সে লক্ষ্যে উদ্যোক্তা তৈরি ও তরুণদের মেধা বিকাশে সব সহায়তা দেবে সরকার বলে জানান তিনি। এসময় তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে সরকারের নানামুখী কার্যক্রমের খতিয়ান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বিনামূল্যে আন্তর্জাতিক সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্ত সুযোগ হাতছাড়াসহ বিএনপি আমলের বিভিন্ন নেতিবাচক সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরেন।


তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিএনপি আমলের নানা অপসিদ্ধান্তের কারণে দেশকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। এ খাতে সংশ্লিষ্টরা জানান, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উপযোগী মানবসম্পদ গড়ে তুলবে এ ইনকিউবেটর। শেখ কামালের নামে এ আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরের নামকরণ করা হয়েছে। এতে আর্থিক ও লজিস্টিক্যাল সেবাসহ প্রায় ২২০ উদ্যোক্তা, প্রশিক্ষণার্থী, ফ্রিল্যান্সার ও সম্ভাবনাময় স্টার্টআপ থাকবে। এ ইনকিউবেটর হচ্ছে স্টার্টআপস ও ব্যবসার জন্য একটি সম্পূর্ণ উদ্ভাবনী ইকো-সিস্টেম। এ ইনকিউবেটরের সঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির সংযোগ থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পগুলোকে বাস্তব প্রকল্প ও পণ্যে রূপান্তর করা যায়, আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি এবং শেখ কামাল ইনকিউবেটর ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।’


আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ এর নেতৃত্ব ও পরামর্শে এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নির্দেশনায় স্মার্ট আইসিটি ডিভিশনের ভিশন-২০৪১ মহাপরিকল্পনা ও রোডম্যাপ প্রণয়নের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের নেতৃত্বে, ডিজিটাল সার্ভিস এক্সিলারেটর, এটুআইয়ের তত্ত্বাবধায়নে এবং স্টার্টআপ বাংলাদেশের সহযোগিতায় উক্ত বিভাগের অধীনস্থ ৮টি দপ্তর-সংস্থার প্রধানের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে লেমন গার্ডেন রিসোর্ট, শ্রীমঙ্গলে ৬ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘ভিশন-২০৪১ : স্মার্ট আইসিটি ডিভিশন’ মহাপরিকল্পনাবিষয়ক ডিজাইন ও পরিকল্পনা ল্যাব। সেই ভিশনকে সামনে  রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ বিনির্মাণের লক্ষ্যে আইসিটি ডিভিশন-২০৪১-এর ভিশন স্মার্ট আইসিটি ডিভিশন নির্মাণে ৪টি (স্মার্ট সিটিজেন,  স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি এবং স্মার্ট গভর্নমেন্ট) স্তম্ভের আলোকে আইসিটি ডিভিশনের যে ভিশন তা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তার অধীনস্থ প্রত্যেকটি দপ্তর/সংস্থা তাদের স্ব স্ব মিশন নির্ধারণপূর্বক শেয়ারড ভিশন অ্যানালাইসিস ও ডিজাইন করে। 


তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলমের সভাপতিত্বে ও নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ডিজাইন ও পরিকল্পনা ল্যাবে বিভাগের অধীনস্থ দপ্তর/সংস্থাসমূহের প্রধান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা অংশগ্রহণ করেন। 


সরকারের পরবর্তী ভিশন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ বাস্তবায়নে ১৪টি কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওই সভায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১’ উপস্থাপন করেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০২১ রূপকল্পের আওতায় যেমন ডিজিটাল শিক্ষা, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা, ডিজিটাল কৃষি ইত্যাদির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে তেমনি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’-এর আওতায় প্রধান অঙ্গ হবে স্মার্ট শিক্ষা, স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট বাণিজ্য, স্মার্ট পরিবহন ইত্যাদি।


লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক 


ফিডব্যাক : [email protected]








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।