https://www.brandellaltd.com/

সাম্প্রতিক খবর

বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশন ও স্মার্ট ক্লাসরুম

বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশন ও স্মার্ট ক্লাসরুম বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশন ও স্মার্ট ক্লাসরুম
 

বাংলা ভাষায় লেখা, বাংলায় ওয়েব অ্যাড্রেস তৈরিসহ সবদিকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু পিছিয়ে আছে ভাষার নিজের ডিজিটালাইজেশনে। আজকাল বহুল চর্চা হচ্ছে ‘ডিজিটালাইজেশন’ শব্দের। ট্রেনের টিকেট থেকে শুরু করে জমির খাজনা সবকিছুই প্রযুক্তির পরশ পাথরের স্পর্শে উজ্জ্বল। কয়েক যুগ আগেও কমপিউটারে বাংলা লেখা বা দেখা কমবেশি কষ্টসাধ্য ছিল; আর তার আগের দশকগুলোতে ছিল অপার বিস্ময়ের। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে পাল্টেছে সাইবার স্পেসে বাংলা আর বাংলাদেশের অবস্থান। পুরনো মডেলের বোতাম চাপা মুঠোফোন থেকে হালের অত্যাধুনিক স্মার্ট ফোন সবখানেই বাংলা ভাষার জয়-জয়কার। ২০১৮ সালের নেওয়া ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবার যে লক্ষ্য ছিল সেটিকে পার করে আজ বাংলাদেশ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। হয়তো ২০৪১-এর আগে বা পরে বাংলাদেশ সেই লক্ষ্য অর্জন করবেও।


ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে ভাষার ব্যবহারেও কম-বেশি ডিজিটালাইজেশন ঘটেছে। বাংলা শব্দভাণ্ডারে জায়গা করে নিয়েছে মোবাইল, কানেকটিভিটি, অনলাইন, মাদারবোর্ড, মাউস, ইন্টারনেট, নেটওয়ার্ক, ই-মেইল ইত্যাদি শব্দসমূহ। এসব শব্দের অনেকগুলো সরকারের ভাষা বাস্তবায়ন কোষ মাধ্যমে স্বীকৃতিও পেয়েছে। অনেক ভাষাবিদ আপত্তি জানালেও, স্বীকার করেন যে, কালের পরিক্রমায় প্রয়োজন আছে বিদেশি শব্দের আত্তীকরণের। মোটা-দাগে বললে, দেশ ডিজিটাল হবার সাথে সাথে শব্দভাণ্ডারও বড় হচ্ছে। কিন্তু বাংলার ডিজিটালাইজেশন কি শুধুই নতুন শব্দের আত্তীকরণে সীমাবদ্ধ? ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ কি আদৌ ডিজিটাল হচ্ছে? যেকোনো ভাষার ডিজিটালাইজেশনের জন্য প্রথম শর্ত কমপিউটারের সাথে সেই ভাষাকে যুক্ত করা। ভাষার সংযুক্তির ক্ষেত্রে মূলত তিনটি বিষয় রয়েছে: ভাষাকে কমপিউটারে প্রবেশ করানো, প্রবেশ করিয়ে দেওয়া ভাষাকে কমপিউটারের নিজের ভাষায় রূপান্তর, আর সেই কমপিউটারের সাহায্যে ডিজিটালি ব্যবহার করা।


বাংলা কমপিউটিংয়ের ইতিহাস প্রায় অর্ধ শতকের। কমপিউটারের স্থানীয়করণ বা লোকালাইজেশনের মাধ্যমে ৮০-এর দশকে শুরু হয় বাংলা কমপিউটিং। পরবর্তীকালে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আর বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে প্রথাগত অ্যাসকি কোড প্রযুক্তি কমপিউটারের এক ধরনের ভাষারূপ ঘুরে বাংলা কমপিউটিং এখন অত্যাধুনিক ইউনিকোড-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে কমপিউটারে উপাত্ত দেওয়ার প্রধান মাধ্যম কিবোর্ডের ক্ষেত্রে বাংলা কমপিউটিংয়ের ইতিহাস আরও অনেকে সমৃদ্ধ। আগের দিনের বাংলা টাইপরাইটার ‘মুনির অপটিমা’-এর নকশা থেকে শুরু করে হালের ফোনেটিক কিবোর্ড পর্যন্ত আসতে তৈরি হচ্ছে অনেকগুলো কিবোর্ড লেআউট বা নকশা। এর মধ্যে শহীদ-লিপি, মাইনুলিপি, বিজয়, অভ্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সরকারিভাবে প্রমিত কিবোর্ড লেআউট তৈরির লক্ষ্যে সংযুক্ত হয় ‘জাতীয় কিবোর্ড’। এসব কিবোর্ড বা লেআউট নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকেলেও উন্নয়ন ও প্রয়োগের পরিমাণ কম না। মোবাইল ডিভাইস ও অফিস-আদালতের কমপিউটার মিলে এখন দেশে কয়েক কোটি কিবোর্ড আছে বলে ধারণা করা হয়।


হতাশার জায়গা হচ্ছে, প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলো যেখানে কিবোর্ডকে পেছনে ফেলে শব্দ আর ছবিকে ভয়েস ও অপটিক্যাল ইনপুট নিয়ে কাজ করছে; আমরা আজও কিবোর্ডের তর্কে নিজেদের আটকে রেখেছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গুগোল লেন্সসহ বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভাষা অনুবাদের ক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে আছি আমরা। এখন পর্যন্ত স্বীকৃত কোনো সফটওয়ার অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিডার তৈরি হয়নি, যা দিয়ে হাজার বাংলা লেখা পৃষ্ঠা দ্রুত ও নির্ভুলভাবে কমপিউটারে নেওয়া যায়।


উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সরকারি অফিসসমূহে শতাব্দী পুরনো অনেক নথিপত্র আছে। পুরাতন হয়ে যাবার কারণে এসব নথিপত্রের লেখা অনেক ক্ষেত্রেই ঝাপসা হয়ে এসেছে, আবার কাগজও অনেক ক্ষেত্রে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। এসব কাগজপত্র নাড়াচাড়া করা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। সেই ধারণা থেকে পুরাতন অনেক নথিকে স্ক্যান করে ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু এটাকে ডিজিটাল বললে আসলে বেশি বলা হবে। কারণ স্ক্যান করে কমপিউটারে নেওয়া ওই ফাইল থেকে এখনও তেমন কোনো রিপোর্ট বা প্রতিবেদন তৈরি করা যাবে না। তবে স্বীকার করতে হয়, কিছু কিছু দপ্তর-সংস্থা কিছু কিছু উন্নতি করেছে।


বাংলা একাডেমিকে বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে সবথেকে পিছিয়ে আছে। এখন পর্যন্ত বাংলা কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির নেতৃস্থানীয় ভূমিকা চোখে পড়েনি। বিশেষ করে জাতীয় কিবোর্ড প্রণয়নের সময় নিশ্চুপ ছিল একাডেমি, যেখানে যেকোনো ভাষার কিবোর্ডেও লে-আউট তৈরির ক্ষেত্রে ওই ভাষার বর্ণমালার গঠন, বর্ণসমূহের পারস্পরিক অবস্থানের পরিসংখ্যান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।


বাংলা একাডেমির অন্যতম দৃশ্যমান কাজ হচ্ছে বিভিন্ন পদক প্রদান ও বইমেলার আয়োজন। বাংলা একাডেমির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞ হচ্ছে প্রকাশনা কার্যক্রম। প্রতি বছর বেশ কিছু নতুন বই ছাড়াও পুরানো প্রকাশনার পুনর্মুদ্রণ করে তারা। অন্যদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশে যখন ই-বুক দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে, তখনও বাংলা একাডেমি ওই পথে হাঁটেনি। এমনকি প্রমিত বাংলা প্রচলনের অন্যতম পূর্বশর্ত অভিধানগুলোকেও ডিজিটাল করেনি বাংলা একাডেমি। ডিজিটালাইজেশনের জন্য সরকার যেখানে বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থাকে দিয়ে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরির চেষ্টা করছে, সেখানে বাংলা একাডেমি রিক্ত হস্তে দাঁড়িয়ে আছে। মোটাদাগে বললে, বেশকিছু বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশনে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। জাপান বা চীনের মতো দেশগুলো নিজেদের ভাষায় তাদের সকল সেবাই ডিজিটাল মাধ্যমে জনগণকে দিচ্ছে। একইরকম অনুশীলন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে ওই দেশগুলো ডিজিটালি নিজ নিজ ভাষার তথ্য, উপাত্ত ও উপকরণকে সহজলভ্য করেছে। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল পাঠ্যপুস্তকের ডিজিটাল প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছে তারা।


কষ্টার্জিত স্বাধীনতা আর ভাষা আন্দোলনের গৌরবকে সঙ্গী করে তরুণ তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সাইবার স্পেসে বাংলা ও বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলা ভাষায় লেখা, বাংলায় ওয়েব অ্যাড্রেস তৈরিসহ সবদিকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু পিছিয়ে আছে ভাষার নিজের ডিজিটালাইজেশনে। বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিতে বাংলা একাডেমি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটসহ অন্যান্য দপ্তর এবং সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।


স্মার্ট ক্লাসরুম


উন্নত-অনুন্নত, ছোট-বড় সব দেশের সব মানুষের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সব মানুষকে দক্ষ করে গড়ে তুলে মানবসম্পদে পরিণত করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান বিশ্ব। তবে এ ক্ষেত্রে অতিক্রম করতে হবে মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক সব বাধা ও সীমাবদ্ধতা। এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে নিয়ে, পিছিয়ে না থাকে যেন কেউ। ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে চলমান রয়েছে এসডিজি। প্রযুক্তির আরও উন্নয়নের নিরলস চেষ্টা চলছে। উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগাতে চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। বিশ্বব্যাপী এসব প্রচেষ্টা মূলত মানুষের শান্তি ও উন্নয়নকে ঘিরে। শান্তি ও উন্নয়ন চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব আসলে শিক্ষার মাধ্যমে। তাই মানুষ কেউ কেউ কাজ করছেন গুণগত শিক্ষা, জীবনমুখী শিক্ষা, কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষা, সৃজনশীল শিক্ষা, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা, সহযোগিতামূলক শিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন নামের শিক্ষার সন্ধানে। এসব শিক্ষার প্রতীকী নাম হতে পারে ‘স্মার্ট শিক্ষা’।


স্মার্ট শিক্ষার জন্য প্রয়োজন স্মার্ট ক্লাসরুম। যথাযথ আলো-বাতাস, বিস্তৃৃত পরিসর, প্রজেক্টর, স্মার্ট বোর্ডসহ আধুনিক সুবিধাযুক্ত একটি কক্ষ স্মার্ট ক্লাসরুমের প্রাথমিক শর্ত হলেও এটিই মূল কথা নয়। এ ক্লাসরুমে পাঠদান করবেন যোগ্য, দক্ষ ও উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশ্বমানের শিক্ষক, যার কথায় ও আদর্শে শিক্ষার্থীরা উদ্বুদ্ধ হবে, স্বপ্ন দেখবে এবং অনুপ্রাণিত হবে; অর্থাৎ উন্নত শিখন পরিবেশে উপযুক্ত শিক্ষক কর্তৃক পাঠদান এবং আধুনিক উপায়ে মূল্যায়ন হবে। সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো না হলেও সিঙ্গাপুর, জাপান, দ. কোরিয়ার মতো হওয়া জরুরি। থাকবে নির্ভুল ও আধুনিক তথ্য-উপাত্ত সমৃদ্ধ পাঠ্যবই। এ শিক্ষার্থীরা হবে দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল আদর্শ নাগরিক। এ শিক্ষার্থীরাই হবে স্মার্ট সিটিজেন এবং এরাই তৈরি করবে স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি আর জনগণ পাবে স্মার্ট বালাদেশ।


বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আরও কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এখনো সেকেলে। যেখানে শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল, সেখানে তা বাড়ানো প্রয়োজন। ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে। আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষায়। কারিগরি শিক্ষা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আমাদের অর্জন এখন প্রায় অর্ধেক। কারিগরি শিক্ষায় বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ জার্মানি। সেখানে কারিগরি শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের পরে, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আমরা এগোতে পারিনি। তারা ব্যবহার করেছিল ডুয়েল ভোকেশনাল ট্রেনিং। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা ভোকেশনাল ট্রেনিং চলাকালেই কোনো কারখানায় উচ্চ বেতনে কাজ করে বাস্তব জ্ঞান লাভ করে। এভাবে তাদের কারিগরি শিক্ষা জনপ্রিয়তা পায়।


শিক্ষায় উন্নতি লাভের জন্য দরকার এ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ। এ খাতে আমাদের ব্যয় এখনো জিডিপির ২ শতাংশের কাছাকাছি, যেখানে ভারতে ৪.৪ শতাংশ, ভুটানে ৫.৯ শতাংশ ও নেপালে ৪.১ শতাংশ। আর গুণগত শিক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এ ব্যয়ের আদর্শ মান হলো জিডিপির ৪-৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ। প্রযুক্তি শিক্ষার ভিত্তি হলো গণিত এবং আন্তর্জাতিক ভাষা হলো ইংরেজি। অথচ এ দু’টি মৌলিক বিষয়ে মাধ্যমিক স্তরে পাঠদানকারী শিক্ষকের প্রায় ৮০ শতাংশই বিষয়সংশ্লিষ্ট নন বেনবেইস গবেষণা থেকে জানা যায়। এটি গবেষণায় প্রমাণিত যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের শিক্ষার্থীরা শিখন ফল বিবেচনায় এগিয়ে থাকে। এ শিক্ষকরা অন্য বিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে গণিত বা ইংরেজি বিষয়ে কখনো কোনো ধরনের প্রশিক্ষণও পান না। তারা প্রশিক্ষণ পান তাদের নিজ বিষয়ে। স্বাভাবিক কারণেই এদের পাঠদান হয় শিক্ষককেন্দ্রিক এবং বক্তৃতা পদ্ধতিতে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয় ধারাবাহিকভাবে বিষয়ভিত্তিক ভীতি  বিশেষ করে গণিত ভীতি, ইংরেজি ভীতি, শিক্ষক ভীতি, পরীক্ষা ভীতি, স্কুল ভীতি বা শিক্ষা ভীতি।


অন্যদিকে গণসাক্ষরতা অভিযানের ২০১৯ সালের গবেষণায় প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকদের ৫৫ শতাংশের বিষয়ভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। আবার মাউশি পরিচালিত ‘ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অফ সেকেন্ডারি স্টুডেন্ট’ গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ইংরেজি ও গণিতে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা খারাপ বা খুবই খারাপ। শিক্ষার অন্যান্য স্তরেও আমরা প্রত্যাশিত অবস্থার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। গবেষণায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি নয়। এদিকে শিক্ষা গবেষণাসহ সার্বিকভাবে গবেষণা খাতে আমাদের ব্যয় খুবই কম। যেসব দেশ যত উন্নত, তাদের গবেষণা খাতে ব্যয় তত বেশি। যাদের হাত ধরে যে কোনো শিক্ষা বাস্তবায়ন হবে, সেই শিক্ষকদের সম্মান প্রদানে আমরা খুবই পিছিয়ে। শিক্ষার মূলভিত্তি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের জন্য আজও তৈরি হয়নি যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্যারিয়ার-পথ। সমগ্র চাকরি জীবনে সহকারী শিক্ষক নামের একই পদ থেকে অবসর নেন অধিকাংশ শিক্ষক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এ ক্ষেত্রে আরও বেশি বঞ্চিত। উল্লেখ্য, মাধ্যমিক স্তরের ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২। টেকসই উন্নয়ন ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে হলে আমাদের অতিক্রম করতে হবে এসব সীমাবদ্ধতা। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ অর্থাৎ উন্নত বাংলাদেশ পেতে এখনই প্রয়োজন শিক্ষায় প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার তথা স্মার্ট ক্লাসরুমের ব্যবহার। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষ পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ।


কান্তি ও উন্নয়নে শিক্ষার অবদানকে স্বীকার করে এবং যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘ ২৪ জানুয়ারিকে ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস হিসাবে। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মানবসম্পদে বিনিয়োগ, শিক্ষায় অগ্রাধিকার’। অর্থাৎ মানবসম্পদ তৈরির উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করতে চাইলে শিক্ষা খাত অগ্রাধিকারযোগ্য। সব সমস্যার সমাধান যেহেতু শিক্ষায়, সুতরাং বিশ্বব্যাপী সংগঠিত হতে পারে শিক্ষাবিপ্লব। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে শ্রেণিকক্ষে শিখনের উপযুক্ত পরিবেশ তথা স্মার্ট ক্লাসরুম। তাই আগামী দিনে শিক্ষায় গবেষণা হয়ে উঠতে পারে খুবই জরুরি ও জনপ্রিয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষাবিপ্লবের এ মিছিলে শরিক হতে হবে আমাদের সবার।


ছাত্রছাত্রীদের কাছে শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতেই চালু করা হয় স্মার্টক্লাস বা ডিজিটাল ক্লাসরুম। শহরের বেশিরভাগ বেসরকারি এবং অভিজাত স্কুলগুলোতে স্মার্টক্লাসের চল আছে। ঠিক যেমন ক্লাসে পড়াবার সময় শিক্ষক-শিক্ষিকারা ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহার করেন ঠিক তেমনভাবেই স্মার্ট ক্লাসরুমগুলোতে এখন ব্ল্যাকবোর্ডের জায়গা নিয়ে নিয়েছে অত্যাধুনিক প্রজেক্টর এবং ডিজিটাল ইন্টারেকটিভ হোয়াইট বোর্ড। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাসের সাহায্যে শিক্ষাদান করা হচ্ছে। স্মার্টক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষাদানের অনেকগুলো ভালো দিক রয়েছে। এর ফলে পড়ুয়াদের কাছে পড়াশোনাটা বেশ আনন্দদায়ক ও সহজ হয়ে উঠবে। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীরা বইতে যা পড়ছে প্রজেক্টরের সাহায্যে সেটাই তাদের চোখের সামনে দেখতে পাবে এবং কঠিন বিষয়গুলোকে তারা সহজেই বুঝতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এর ফলে যে সব পড়ুয়া স্কুলে অনেক কম উপস্থিত থাকতো তাদের উপস্থিতিও অনেক বাড়বে। এছাড়াও যে সব কক্ষে অনেক ছাত্রছাত্রী রয়েছে সেই সব কক্ষে একেবাওে শেষের দিকে যারা বসে তারা অনেক সময় শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকার গলার স্বর শুনতে পায়না কিংবা বোর্ডের লেখা ঠিক মতো দেখতে পায় না। তাই তাদের জন্য এই ধরণের ইন্টারেকটিভ হোয়াইট বোর্ডেও লেখাগুলো মাপ মতো বাড়ানো বা ছোট করাও যায়। অনেক সময় ছাত্রছাত্রীরা নোট নেওয়ার সময়  তাড়াতাড়ি লিখতে গিয়ে অনেক কিছু বাদ দিয়ে বসে তাই শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকা বোর্ডে সেই পাতাটিকে 'সেভ' করে রেখে দিলে সেই পড়ুয়া বাদ দিয়ে দেওয়া অংশগুলো আবার পরে লিখে নিতে পারে।


এর অনেক সুবিধাও যেমন রয়েছে পাশাপাশি বহু অসুবিধাও রয়েছে। কারণে এই ধরণের স্মার্টক্লাস পরিচালনা করার জন্য স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। সেই অর্থে কোনও প্রশিক্ষণ পান না শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এই ধরণের ক্লাসরুম ব্যবস্থার থেকে যাতে ছাত্রছাত্রীরা সম্পূর্ণ সুবিধা পেতে পাওে সেই জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তাই শুধুমাত্র স্মার্ট ক্লাসরুম থাকাটাই যথেষ্ট নয় যাতে পড়ুয়ারা উপকৃত হতে পাওে সেই দিকটাও নিশ্চিত করতে হবে।


বহু গ্রামাঞ্চলের স্কুলেও এখন ডিজিটাল বা প্রজেক্টরের সাহায্যে শিক্ষাদানের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই সব স্কুলগুলোর ওই একই চিত্র। মেশিন থাকলেও সেগুলোর সাহায্যে পড়াবার জন্য যথেষ্ট প্রশিক্ষণের আকাল। তাই ইচ্ছে থাকলেও সে সব মেশিনকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ ছাড়াও আরও একটা ব্যাপার হল কোনও স্কুলে স্মার্টক্লাস চালু হওয়ার পর বেশ কয়েকদিন দেখভাল করা হলেও কয়েকদিন পর থেকে পুরো বিষয়টিকে তেমন ভাবে আর তত্ত্বাবধান করা হয় না। অর্থাৎ ক্লাস উপযোগী মডিউলের সাহায্যে পড়ান হচ্ছে কী না, সেই সব মডিউল সময় মতো আরও সময় উপযোগী করা হচ্ছে কী না, দরকার মতো সফটওয়্যার আপডেট করা হচ্ছে কী না এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা স্মার্টক্লাসের সাহায্যে ছাত্রছাত্রীদের ঠিকঠাক ভাবে পড়াতে পারছেন কী না সেটাও আমলে নিতে হবে।


হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।