২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন ‘রূপকল্প ২০২১’, যার মূল উপজীব্য ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ। তারুণ্যের মেধা ও শক্তিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানোর এক অনবদ্য ও প্রেরণাদায়ী কর্মসূচি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্য পূরণের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপই মূলত আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ। রূপকল্প ২০২১-এর অধীনে ঘোষিত সময়ের আগেই একটি সুখী, সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। যে মশাল বঙ্গবন্ধু জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিলেন তার সুযোগ্য উত্তরসূরিরা আজও নিষ্ঠার সঙ্গে তা বহন করে চলেছেন।
এক দশক আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটা খুব বেশি পরিচিত ছিল না এদেশের মানুষের কাছে। তবে একেবারে অপরিচিত ছিল তাও বলা যাবে না। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল’ রূপ পেল বাংলাদেশ। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’Ñ এক বার্তা নিয়ে হাজির হলো আমাদের মাঝে। অনেকের কাছে বিষয়টা একটু নতুন ছিল। বেশিরভাগ মানুষ এর ব্যাপ্তি, গভীরতা, অন্তর্নিহিত অর্থ, বাস্তবিক প্রয়োগ সম্পর্কে প্রায় ধারণাহীন ছিল। গত দশ বছরে তাদের সেই ধারণার জগত অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দটি শোনার পর সবার মনে প্রশ্ন ছিল বিষয়টি আসলে কী? ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে এক সুখী, সমৃদ্ধ, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বৈষম্যহীন জনগণের রাষ্ট্র, যার মুখ্য চালিকাশক্তি হলো ডিজিটাল প্রযুক্তি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারের ২০২১ রূপকল্পে একুশ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ডিজিটাল বিষয়টি এখন সারা দুনিয়ার প্রবণতা। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোরÑ যাদের সাথে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মিল রয়েছে তাদের জন্য এই কর্মসূচি। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচিতে জড়িয়ে আছে আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক বিষয়। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য রাষ্ট্র তথা সরকারকে পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা। জনগণ রাষ্ট্রকে কর দেবে, কিন্তু রাষ্ট্র জনগণের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান বা চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটাবে এটাই তো প্রত্যাশা ডিজটাল বাংলাদেশের কাছ থেকে।
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি হবে বৈষম্যহীন ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, ছাত্র, নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের অনুক‚লের। ডিজিটাল মাধ্যমসহ সব মিডিয়ায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এই সংক্রান্ত সব তথ্য প্রকাশ করবে, যা ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনগণ অনায়াসে পাবে। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব জনগণের ওপর ন্যস্ত করার জন্য একটি কার্যকর ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকরী রয়েছে। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও সরকারের সব স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়েই দেশ পরিচালিত হচ্ছে। একটি নির্বাচিত সরকার কাজ করছে। জাতীয় সংসদকে কার্যকরী করে এগুচ্ছে দেশ। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হিসেবে জেলা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ কাজ করছে। সরকারি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করছে। দেশটি পুরোপুরিভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে এবং এর সব কর্মকাÐ এমনভাবে পরিচালিত হবে যে, জনগণ রাষ্ট্রীয় সব কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নিতে পারবে এবং রাষ্ট্রীয় সব তথ্যে জনগণের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে। প্রশাসনকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রশাসনের সব তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হচ্ছে। সরকারকেও হতে হবে আরো ডিজিটাল সরকার। জনগণ ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে যাতে সরকারের সাথে অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনায় অংশ নিতে পারে ও মতামত দিতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে, যা ব্যাপকভাবে করতে হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালুতে উদ্যোগ নিতে হবে। শিশুশ্রেণী থেকে কমপিউটারসহ অন্যান্য বিজ্ঞান বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ করার ব্যবস্থাসহ কমপিউটারকে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা এখনই জরুরি। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ডিজিটাল যুগ বা জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাও দেয়ার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। বিচার বিভাগ, কর্ম কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাও ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি অংশ। রাজনৈতিক দলসমূহ বিধিবদ্ধ ও জবাবদিহিমূলকভাবে স্বচ্ছতাসহ গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এখনই। এসব ব্যবস্থার সব তথ্য জনগণের কাছে পাওয়ার উপযোগী করার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবি। সব রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও রাজনীতিকদের রাজনৈতিক জীবনাচার সংক্রান্ত সব তথ্য উন্মুক্তভাবে সব জনগণের জন্য প্রকাশ করা এই ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি অংশ।
একুশ শতকে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের যুগে রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা নতুন জোয়ার এসে জীবনধারায় নতুনত্বের আবাহনই তৈরি হতে যাচ্ছে। এনালগ যুগ পেরিয়ে দেশ ডিজিটাল যুগে ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাই একালের নেতৃত্ব জ্ঞানে, মেধায়, তথ্যপ্রযুক্তি আর মননে সমৃদ্ধ হয়ে উন্নয়নশীল দেশ গঠনের পথকে করে তুলবে মসৃণ। সংস্কৃতিহীন যে মানবসমাজ তৈরি হয়েছে তা সমাজে নানা অসঙ্গতি সৃষ্টি করতেই হয়েছে পারদর্শী। কিন্তু সুবিধাবাদী চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়ে নানা পথে আর্থিক সুবিধা নিয়ে রাজনীতিতে পদ ও পদবি অর্জন করার মতো ক্ষমতাবান হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই রাজনীতিতে এত মতলববাজ, কুচরিত্রের সমাহার ঘটেছে। স্বল্পসময়ে অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়ারা যখন জাতীয় রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নেয় তখন রাজনীতির গুণগত মান অনেক নিচে নেমে যায় তখন রাজনীতি ডিজিটাল না হয়ে অ্যানালগ হয়ে যায়। রাজনীতি তাই অনেকের কাছে হয়ে গেছে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার। একুশ শতকের রাজনীতিতে তাই গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি। গণবিচ্ছিন্ন, গণবিরোধীরা রাজনৈতিক অঙ্গনে দাপটের সাথে ছড়ি ঘুরিয়ে চলছে শিক্ষিত, মেধাবী নেতৃত্বের ঘাটতির সুযোগে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকে রাজনীতি যে অবস্থানে ছিল, আজকে তার লেশটুকুও নেই। এক সময় নেতারা সাধারণ মানুষের কাছেও সম্মান পেতেন, এখন তারা আর সেই সম্মান অর্জন করতে পারেন না অনেক ক্ষেত্রেই। রাজনীতিকেও জনগণ সহজ এবং ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে বলে অনেক সময় মনে হয় না। বরং রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের একটা বীতশ্রদ্ধভাব দেখা যায়। তাই এই ডিজিটাল যুগে রাজনীতিকেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। ডিজিটাল এই যুগে রাজনীতিকেও ডিজিটাল হতে হবে এটা এখন সময়ের দাবি।
ডিজিটাল বাংলাদেশকে পরিপূর্ণতা দিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এবং রাজনীতিবিদদেরও ডিজিটাল হওয়া দরকার। এমনকি প্রতিটি রাজনীতিবিদকেও ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা নেয়া এখন জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দল এবং ব্যক্তিগত কার্যক্রম আরো বেশি ডিজিটালি হওয়া উচিত। না হলে সাধারণ মানুষ বাস্তবতাকেও সেøাগান মনে করবে। তার জন্য সাধারণ মানুষকে কোনো দোষ দেয়া যাবে না।
ডিজিটাল বাংলাদেশ এদেশের মানুষের কাছে এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। সেটা শহরের মানুষ থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীÑ কমবেশি ধারণা এখন মোটামুটি প্রায় সবার আছে। একটা প্রজন্মের কাছে তাদের স্বপ্নের জগতটাই এখন ডিজিটাল। ডিজিটাল এক জগতেই তাদের বসবাস। তবে উন্নত পৃথিবীর সাথে তুলনা করতে গেলে আমরা পিছিয়ে অনেক জায়গায়। অন্যরা যখন ফাইভজি নিয়ে চলে আমরা তখন ফোরজি নিয়ে কাজ করি। তারপরও বিশাল এই জনগোষ্ঠী উন্নত বিশ্বের সাথে তাল রেখে চলার চেষ্টা করছে, সেটাই অনেক। গত দশকে সেটা ভাবাও যায়নি। তবে আগামীর পৃথিবী এগিয়ে চলেছে অনেক দ্রæতগতিতে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের আরো অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাইজড হওয়া দরকার। এর দায় শুধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের তা নয়। যারা নীতিনির্ধারক কিংবা জনগণকে পথ দেখানো যাদের কাজ তাদের সাথে নিয়ে চলার কথা যাদের, তারা ঠিক চলতে চান না। কিংবা জনগণকে সাথে নিতে অনাগ্রহী। রাজনীতিবিদের কাজ দেশকে এগিয়ে নেয়া। দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখানো। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। কিন্তু সত্যি-ই কী আমাদের রাজনীতিবিদরা সেই কাজটা খুব আন্তরিকভাবে করছেন। বা করতে চাইছেন? বাস্তবতা কী বলে।
এক দশক আগে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে দলটা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রথম ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলল, তারা একনাগাড়ে বারো বছরের বেশি সময় ক্ষমতায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে তারা কী ভাবছে। রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ডিজিটাল হতে পেরেছে? তাদের নেতারা কতটা ডিজিটাল? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কী হতে তাদের অবদান তা নিয়ে এখনি ভাবতে হবে। তবে তাদের কাজকর্ম, কথাবার্তা শুনে মনে হয়, দেশের মানুষ নিয়ে তাদেরকে বেশি ভাবতে হয় এবং হচ্ছে, কিন্তু যারা দল চালানোর দায়িত্ব নিয়েছেন তারা কি ডিজিটালি কোনো কিছু করতে পারছেন?
বর্তমানে এমন একটা সময় এসে দাঁড়িয়েছে যখন ডিজিটাল ও বিকল্প মিডিয়াগুলো তাদের সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও পেশাদার মিডিয়াগুলোর চেয়ে বড় না হলেও অন্তত সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভার্চুয়াল বিশ্বে উপস্থিতিটা এখন অনেক সহজ এবং এতে জনমত গড়ে তোলাটাও আরও সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ‘বিগ ডাটা অ্যানালাইসিস’ ও ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে আমরা প্রত্যেকে ব্যবহারকারীর ছোটখাটো পছন্দ, চাহিদা সম্পর্কে নিখুঁত ধারণা পেতে পারি।
আর এই প্রযুক্তির সহায়তায় এখন রাজনীতিবিদরা প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে তার পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী বার্তা পাঠাতে পারেন, নির্বাচনে ভোট চাইতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগ বা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছে তাদের বার্তা দিতে পারেন এবং ফেসবুকে তাদের বার্তা প্রদান বা ফলোয়ার তৈরি করতে পারেন। জনগণের সুবিধা অসুবিধা শুনতে পারেন। এমপি-মন্ত্রীরা জনগণের সাথে তাদের ভাবনা, তথ্য, সুবিধা অসুবিধা শেয়ার করতে পারেন; এতে করে জনগণ-রাজনীতিবিদ উভয়েই ডিজিটাইজেশনের সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। সমস্যা দূর করা যাবে। তাই রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ডিজিটাইজেশনের আওতায় আসা জরুরি।
০ টি মন্তব্য