কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন
বিশ্ব এখন মারাত্মকভাবে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলার জন্য লড়াই করছে এবং বাংলাদেশও তাই করছে। মহামারিটি বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোর চ্যালেঞ্জ বয়ে এনেছে। শিক্ষা খাতসহ অন্যান্য খাত এবং বেকার যুবকদের আরো গভীর সমস্যায় ফেলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এখনও এই সমস্যা সমাধানে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। এই বৃদ্ধির গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছেন কেউ কেউ।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি, যুবদের প্রশিক্ষণ, যুবদের জন্য আইসিটির বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও যুব উদ্যোক্তা তৈরী করে যুবদের কর্মসংস্থান এবং আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য এগিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটি করাই এখন জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য। কভিড-১৯ এর ছোবলে দেশের অর্থনীতি ক্ষত-বিক্ষত হলেও এখন পুরা উদ্যমে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চলছে।
গত বছর করোনার অভিঘাতে চাকরিচ্যুত হয়েছিলো শতকরা ৩৬ জন মানুষ। অনেকের চাকরি থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত বেতন-ভাতা পান নি। তবে সংকটকালীন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সার্বিক সুরক্ষা ও জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য উন্নয়ন কার্যক্রম এবং জনবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলো সরকার। স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতির চাকা চলমান রাখতে কিছুটা হলেও অবদান রেখেছিলো।
নতুন করে ৩ কোটি ২৮ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছেন (তথ্য বিআইজিডি জরিপ)। করোনার প্রথম চার মাসেই বেকারত্ব বেড়েছিলো ১০ গুণ। আর্থিক সংকটে পড়া ৪৬ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে এবং ৪৩ শতাংশের বেশি পরিবার আত্মীয়স্বজনের সাহায্য-সহায়তার ওপর নির্ভর করে সংসার চালিয়েছে (বিবিএস, ২০২০)।
অভিবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও গত অক্টোবরে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ৪৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। কোভিড--১৯ এর অভিঘাতের আগেই যুবকদের অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুব বেকারত্বের হার ছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। বিআইডিএস এক গবেষণায় দেখিয়েছে, শিক্ষিত যুবকদের প্রায় ৩৩ শতাংশই ছিল বেকার। আইএলও ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে ১১ দশমিক ১৭ লাখ থেকে ১৬ দশমিক ৭৫ লাখ যুবক বেকার হতে পারেন।
অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ বা মন্দার কারণে জনগণের চাকরির ক্ষতি হচ্ছে, নিয়মিত বেতন না পাওয়া কম বেতন পাওয়া বিশেষ করে বেসরকারী চাকুরিজীবীদের বেলায় এমনটি ঘটছে। চাকরির বাজার হ্রাস পাবার কারণে অনেক তরুণকে হতাশার মধ্যে ফেলেছে। তরুণ চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে (নিউ নরমাল সিচুয়েশন) তীব্র উদ্বেগ এবং চাকরির বাজারে কভিড-১৯ প্রভাব নিয়ে সময় আলোচনা করে সময় কাটাতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ (এসডিজি) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর জন্য, বর্তমান সরকার যুবকদের বিভিন্ন চাকুরির সুযোগ তৈরি করছে। তাছাড়াও সুনির্দিষ্ট চাকুরি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সরকার আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
আমাদের একটি গণমুখি এবং কর্মমুখি শিক্ষা প্রদান করাও খুব জরুরি। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের কর্মসংস্থানের দিকে নজর দেয়া দরকার। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে বিনষ্ট না করে সঠিকভাবে শিক্ষিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য যেমন শিক্ষকদের দায়িত্ব থাকে তেমনি পিতা-মাতা এবং নাগরিক সমাজেরও এটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
রকারী দল, বিরোধী দল, এবং সুশীল সমাজসহ সমাজের প্রত্যেকেরই কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সবার একটি দায়িত্ব রয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ; দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিহীন ও দুর্নীতিমুক্ত রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বাইপাস করে চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। বড় ডিগ্রি নিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থার বাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতি না থাকায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্বের প্রায় সব দেশে উচ্চ শিক্ষায় যায়। তবে এখানে আমাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যবস্থা রয়েছে। চাকরি পেতে চাইলেও উচ্চশিক্ষা ডিগ্রি অর্জন জরুরি। অবস্থান যাই হোক না কেন!
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শ্রমবাজারের জন্য দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত দক্ষ কর্মীদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারছেনা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পড়াশোনা বিশেষ দক্ষতার অভাবে পড়াশুনা সম্পন্ন তরুণ-তরুণীদের চাকরির বাজারের চাহিদা মেটাতে পারছে না। কলেজের স্নাতকদের মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশই পূর্ণকালীন বা খ-কালীন কর্মরত, প্রায় অর্ধেক বেকার রয়েছে। অধিকন্তু, যুব নারী গ্র্যাজুয়েটদের বেকার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং স্নাতকোত্তর হওয়ার দুই বছর পরে দেখা গেছে নারী স্নাতকদের ৩৩ শতাংশ পুরুষ স্নাতকের বিপরীতে বেকার রয়েছেন বলে এসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী, প্রধান খাতগুলি হলো তথ্য প্রযুক্তি, কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, শিপ-বিল্ডিং এবং তৈরি পোশাক, পর্যটন ও পর্যটন পরিষেবা, হালকা প্রযুক্তিগত নির্মাণ শিল্প তবে এই ক্ষেত্রগুলির জন্য, মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রযুক্তিবিদদের (বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ) অভাব রয়েছে। এর জন্য, কী ধরনের দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন তার উপর ভিত্তি করে একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পোশাক খাত এত বড় তবে উচ্চ শিক্ষায় এর কোন গুরুত্ব নেই। একই কথা চামড়া সেক্টর এর জন্যও বলা যায়। ফলস্বরূপ, এই খাতগুলি বিদেশী কর্মীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। বিশেষায়িত কাজের জন্য দেশে সর্বনিম্ন পর্যায়েও যোগ্য শ্রমিক না থাকায় উদ্যোক্তারা বিদেশী শ্রমিক নিয়োগে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষাব্যবস্থার ব্যবধানের কারণে বাংলাদেশে বেকারত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা তাদের আগ্রহ এবং পছন্দসই বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া একটি বাধ্যতামূলক বিষয় সেখানে অনেকসময় পছন্দের বিষয় ভাগ্যে জোটেনা। আবার কাজের ক্ষেত্রে, দক্ষতা প্রয়োজন যেখানেই সুযোগ আসবে সেখানে আপনাকে যোগদান করতে হবে এবং কাজের দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে।
তবে যুবকদের বেকারত্বকে অর্থনীতির একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি আমাদের বিভিন্ন নীতিমালাগুলোতে। জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ এ যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া হয়নি। নীতিমালায় তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও কোনও দৃশ্যমান পরিকল্পনা নেই। অবশ্যই, অর্থনীতিতে বেসরকারী খাতের অবদান বেশি হওয়ার কারণে, কর্মসংস্থানের বড় উৎস হতে হবে বেসরকারী খাতকে। সরকারকে সেখানে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে নীতি সহায়তা প্রদান করতে হবে।
এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে, শিক্ষায় কঠোর মানের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এজন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অনুমোদনের কাঠামো, তদারকি ও মাননিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে করতে হবে। উচ্চ শিক্ষার পাঠ্যক্রম তৈরি করতে পাঠ্যক্রমটি বাজার চাহিদা অনুযায়ী আপডেট করা দরকার। আইন প্রণেতা, বিনিয়োগকারী, নিয়োগপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। সেই সাথে সরকারকে কিছু প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কেবলমাত্র সুশিক্ষা নয়, প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও স্ব-উদ্যোগে কাজ করার আগ্রহও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমরা যুবকদের একটি শিক্ষা প্রদান করে জীবনে ভালোভাবে কেরিয়ার তৈরি করতে পারে সে শিক্ষাই চাই। আমরা বেকারত্বের অভিশাপ দেখতে চাই না, আমরা যুবকদের হতাশ দেখতে চাই না, আমরা যুবকদের উদ্যোগী হিসেবে দেখতে চাই। তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য নতুন চাকুরি সৃষ্টি করা বা কর্মসংস্থানের সম্মিলতি উদোগ গ্রহণ করা জরুরি। বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য একটি কার্যকর উপায় বের করা যেতে পারে। অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও সম্প্রসারণ এবং অন্যান্য কার্যক্রম হাতে নেয়া জরুরি। এ্েক্ষত্রে ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কাজের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরকারের বিভিন্নখাতগুলোর একটি চিত্র থাকতে হবে।
আমাদের অর্থনীতি এখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। গত দশকে ধীরে ধীরে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সাথে দেশটি ইতিবাচক অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তবে যুবদের বেকারত্ব আমাদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে কাঁটা না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নও তরুণদের সম্ভাব্যতা এবং তাদেও শ্রমশক্তি ও মেধার বিকাশ এবং কার্যকর ব্যবহারের উপর নির্ভর করবে, কারণ মানব সম্পদ হলো আমাদের আমাদের উন্নয়নের মূল সম্পদ। তাই এ বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করাই এখন সকলের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
				
							
												










০ টি মন্তব্য