https://powerinai.com/

তথ্যপ্রযুক্তি

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি
 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি


বাংলাদেশের ওপর দিয়ে গত ১৫ নভেম্বর বয়ে গেল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর৷ সিডর কেড়ে নিলো প্রায় চার হাজারেরও বেশি প্রাণ৷ আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক৷ এখনো এর পরিমাণ নির্ধারণের অপেক্ষায়৷ তবে ক্ষতিটা যে কয়েক হাজার কোটি টাকার তা বলাই বাহুল্য৷ আমরা কথায় কথায় তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে বড়াই করি৷ কিন্তু প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করে ও আমরা দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে পারলাম না৷ মানুষ অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখলো ঘূর্ণিঝড়ের তা-ব৷ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কয়েক কোটি মানুষ প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে আছে৷ প্রযুক্তির সহায়তায় আমরা এক্ষেত্রে কী কী করতে পারতাম, কিভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো কমিয়ে আনতে পারতাম যেসব বিষয় নিয়ে আমাদের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখেছেন মর্তুজা আশীষ আহমেদ ৷


সিডর হচ্ছে সিংহলি শব্দ, যার অর্থ চোখ৷ এমন নাম দেয়ার কারণ, এই হারিকেনটির কেন্দ্রীয় অংশ দেখতে অনেকটা চোখের মতো৷ ধারণা করা হচ্ছে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়৷ কিন্তু সে তুলনায় জীবনের ক্ষয়ক্ষতির হার বেশ কম৷ বেশ কম এই অর্থে যে ১৯৭০ সালে ও ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সিডর থেকে কম শক্তিশালী দুটি ঘূর্ণিঝরে আঘাতে যথাক্রমে প্রায় ৩ লাখ ও ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়৷ কিন্তু কথা হচ্ছে, উন্নত বিশ্বে এর চেয়েও শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্যোগেও হতাহতের পরিমাণ অনেক কম হয়ে থাকে৷ এটি সম্ভব হয় উন্নত প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োগের কল্যাণে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে প্রযুক্তির একটি বিভাগ আছে, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় কিভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম রেখে দুর্যোগ মোকাবেলা করা যায় সেটি নিয়ে গবেষণা করা হয়৷ বাংলাদেশে এ ব্যাপারে সবারই আরো সচেতন হতে হবে৷ তাহলে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম রেখে দুর্যোগ মোকাবেলা করা যেত৷ আমরা দেখবো, উন্নত বিশ্বে কিভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা করা হয়৷


কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি


বিশ্বের অনেক দেশই এখন দুর্যোগের প্রাথমিক লক্ষণ অনুসন্ধানের জন্য কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে৷ এটি বেশ আগের প্রযুক্তি৷ বাংলাদেশও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসসহ দুর্যোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সংগ্রহ করে থাকে৷ বাংলাদেশ ১৯৮০ সাল থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে৷ বাংলাদেশ দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে ছবি সংগ্রহ করে থাকে৷ এই উপগ্রহ দুটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নোয়া এবং এফওয়াইটুসি৷ ১৯৮০ সারে পর থেকে বাংলাদেশ শুধু নোয়া থেকে প্রতিদিন দুটি করে ছবি সংগ্রহ করতো৷ এই ছবি থেকেই নির্ণয় করা হতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের খবরাখবর৷ এফওয়াইটুসি ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরাখবর নির্ণয় করা অনেক সহজ হয়ে গেছে৷ এফওয়াইটুসি একটি আবহাওয়াবিষয়ক কৃত্রিম উপগ্রহ৷ ধারণা করা হচ্ছে, এফওয়াইটুসি ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে বলেই এবারের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এই কৃত্রিম উপগ্রহপ্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক ব্যবহৃত প্রযুক্তি৷


কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তির অনেক আধুনিকায়ন হয়েছে৷ এমন অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ আছে, যেগুলো এফওয়াইটুসির মতো নয়৷ এফওয়াইটুসি আলোর প্রতিফলনকে কাজে লাগিয়ে ছবি তৈরি করে৷ কিন্তু এ ধরনের ছবি তোলার ক্ষেত্রে একমাত্র সমস্যা হলো আলো, স্বল্প আলো বা মেঘলা আকাশে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো ছবি তুলতে পারে না৷ এই ছবি তোলার প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন হয়েছে৷ আলোর সাহায্য ছাড়াই মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমেও ছবি তোলা যায়৷ সেক্ষেত্রে আলো কোনো সমস্যা নয়৷ এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর জন্য মাটিতে আলাদা মাইক্রোওয়েভ বেইজ স্টেশন থাকতে হয়৷ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ট্রান্সমিট করা মাইক্রোওয়েভ কৃত্রিম উপগ্রহে প্রতিফলিত হবার ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ছবি তৈরি করা হয়৷ এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ কিছুটা ব্যয়বহুল৷ পৃথিবীর অনেক দেশই এখন এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে দুর্যোগের পূর্বাভাসসহকারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করে৷


তথ্যভিত্তিক ওয়েব প্রযুক্তি


ইন্টারনেটের মাধ্যমেও এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ এখনকার সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলো প্রতিনিয়ত নিজেদের সংবাদ-তথ্য হালনাগাদ করে থাকে৷ এই হালনাগাদ করা শুধু যে সংবাদভিত্তিক তা নয়৷ এগুলো যথাযথ চিত্রভিত্তিক৷ যেমন বিবিসি, সিএনএন, এপি, এএফপি প্রভৃতি সাইটগুলো দুর্যোগের চিত্রভিত্তিক সংবাদ প্রচার করেছে৷ সংবাদভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন অত্যাধুনিক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে৷ তাছাড়াও চিত্রভিত্তিক বিভিন্ন সাইট সাম্প্রতিক আবহাওয়াসংশ্লিষ্ট ছবি প্রকাশ করে থাকে৷ যেমন নাসা-র আর্থ অবজারভেটরি, ইয়াহু ইমেজ প্রভৃতি৷ তাছাড়াও আবহাওয়াভিত্তিক অনেক ওয়েবসাইট আছে, যেগুলো থেকে খবরাখবর নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ কিছু কিছু ওয়েবসাইট আবহাওয়াসংশ্লিষ্ট ভিডিও প্রকাশ করে থাকে৷ যেমন- ইউটিউব৷ এই সাইটগুলোতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় সিডরের বিভিন্ন তথ্য ও ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে৷ সুতরাং ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ ওয়েব সাইট : www.youtube.com, www.afp. com, www.ap.org, news.bbc.co.uk/1/ hi/world/asia-pacific/default.stm


সফটওয়্যার প্রযুক্তি


তথ্যপ্রযুক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে সফটওয়্যারের বিপ্লব৷ সফটওয়্যারের মাধ্যমেও এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ আজ গুগল আর্থ-এর কথা আমরা সবাই জানি৷ এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ছবি দেখা বা তোলা সম্ভব৷ এধরনের ইন্টারনেটভিত্তিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে আগে থেকেই দুর্যোগের বিভিন্ন ছবি পাওয়া সম্ভব৷ বাংলাদেশে সিডর আঘাত হানার আগেই গত ১৪ নভেম্বর থেকেই গুগল আর্থে ঘূর্ণিঝড়ের ছবি দেখা গেছে৷ গুগল আর্থ নিয়মিতই হালনাগাদ তথ্য পরিবেশন করে থাকে৷ দুর্যোগের আগে ও পরে এমন সফটওয়্যারের মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ ওয়েব সাইট earth.google.com


স্যাটেলাইট ফোন প্রযুক্তি


এমনি আরেকটি প্রযুক্তি হলো স্যাটেলাইট ফোন৷ স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে আজকাল উন্নত বিশ্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে৷ আমাদের দেশে এখনো স্যাটেলাইট ফোন পরিচিত নয়৷ আশা করা যায় স্যাটেলাইট ফোনের ব্যবস্থা করা গেলে এরকম বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো কম হবে৷ স্যাটেলাইট ফোন বা স্যাটফোন অনেকটা মোবাইল ফোনের মতোই টেলিফোন সিস্টেম৷ পার্থক্য হলো এটি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় স্যাটেলাইটকে৷ যোগাযোগের জন্য তৈরি করা বিশেষ স্যাটেলাইটের সাহায্যে স্যাটফোন কাজ করে৷ মোবাইল ফোনের সাথে এর মূল পার্থক্য হলো, মোবাইল ফোন কাজ করে কাছাকাছি থাকা বেইজ স্টেশনের মাধ্যমে৷ আর স্যাটফোনের ক্ষেত্রে বেইজ স্টেশনের বদলে সরাসরি স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়৷ এর ফলে মোবাইল ফোনের চেয়ে সুবিধা অনেক বেশি পাওয়া যায়৷ এই সুবিধাগুলো হলো নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সুবিধা ও এর কভারেজ অঞ্চল অনেক বেশি৷ সেই সাথে নেটওয়ার্ক ডাউন হবার প্রবণতাও কমে যায়৷ আমরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করি বলে এর বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা জানি৷ নেটওয়ার্ক না থাকলে বা নেটওয়ার্কে ঝামেলা দেখা দিলে এই ফোন হয়ে ওঠে এক অসহ্য যন্ত্রণাময় জড়বস্তু৷ সাম্প্রতিক দুর্যোগ সিডরের কথাই ধরুন, এ দুর্যোগের সময় বাংলাদেশের কোনো মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে সার্ভিস দিতে পারেনি৷ বস্তুত এর ফলে ক্ষয়ক্ষতি আরো বেড়েছে৷ মোবাইল ফোন সক্রিয় থাকলে ক্ষতির পরিমাণ হয়ত আরো কম হতে পারত৷ আমরা এটাও দেখেছি, শুরুতে মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে কতটা বেগ পেতে হয়েছে৷ স্যাটফোন এখনো অনেক ব্যয়বহুল৷ কিন্তু স্যাটফোনের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে এতটা বেগ পেতে হতো না৷ মাত্র একটি স্যাটেলাইটেই অর্ধেক পৃথিবী কভার করা সম্ভব৷ সিডরের তা-বের ফলে মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচুর নেটওয়ার্ক টাওয়ার পড়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ স্যাটফোনের ক্ষেত্রে এমনটি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ কারণ, এটি নিজেদের নেটওয়ার্ক ট্রান্সমিট করে মহাকাশ থেকে৷ স্যাটফোনের সমস্যা একটাই, খরচ অনেক বেশি৷ স্যাটফোনের ব্যবহারকারীর যন্ত্রাংশকে (ইউজার এন্ড ডিভাইস) আর্থ স্টেশন বা টার্মিনাল বলে৷ এই টার্মিনালগুলো বেশ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হয়৷ এগুলোর ট্রান্সমিটিং ও রিসিভিং ক্ষমতা অন্যান্য যেকোনো ধরনের ফোনের চেয়ে বেশি৷ তবে ট্রান্সমিটিং ও রিসিভিং অনেক দূর থেকে হয় বলে অনেক সময়ই বহুতল ভবনগুলোর নিচের সারির ফ্লোরগুলোতে নেটওয়ার্ক নিয়ে কিছুটা সমস্যা হতে পারে৷ এজন্য স্যাটফোনের নির্মাতারাও বলে দেন, মহাকাশ অভিমুখে থাকা অবস্থায় এর পারফরমেন্স সবচেয়ে ভালো পাওয়া যাবে৷ স্যাটফোনের এটি একটি সীমাবদ্ধতা৷ আরো কিছু সীমাবদ্ধতা আছে স্যাটফোনের৷ যেকোনো ফোন সিস্টেমে আমরা খুব সহজেই যেভাবে কথা বলতে পারি, স্যাটফোনে ততটা সাবলীলভাবে কথা বলা সম্ভব নয়৷ অনেক দূর থেকে ট্রান্সমিটিং ও রিসিভিং হয় বলে কথা কিছুটা দেরিতে শোনা যায়৷ তবে জরুরি প্রয়োজন যেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এটি কোনো সমস্যা নয়৷ অবশ্য প্রযুক্তির উত্কর্ষে এই সমস্যা এখন অনেকটাই দূর হয়ে গেছে৷


স্যাটেলাইট ফোন কাজ করে অনেকটা মোবাইল ফোনের মতো করেই৷ একটি স্যাটফোন ডিভাইস কল করার সময় নিকটবর্তী স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে৷ স্যাটেলাইট এখানে তথ্যকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে৷ স্যাটেলাইট এর পরে খুঁ জে বের করে সেই ব্যবহারকারীর অবস্থান যাকে কল করা হয়েছে৷ এরপরে সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কলকারী এবং কল গ্রহণকারী উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়৷


স্যাটফোন স্যাটেলাইটনির্ভর হওয়াতে এর ধরনও একটু আলাদা৷ আলাদা বলতে নির্দিষ্ট স্যাটেলাইটের ওপর ভিত্তি করে স্যাটফোন কাজ করে৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোন দেশের কোড অনুযায়ী পরিচালনা করা হয়৷ দেশের অভ্যন্তরে হলে সেক্ষেত্রেও আলাদা আলাদা কোড আছে৷ স্যাটেলাইট ফোনের ক্ষেত্রে এমন কোনো ব্যাপার নেই৷ যেমন- ইনমারস্যাট, ইরিডিয়াম, গ্লোবাল স্টার প্রভৃতি স্যাটেলাইটের নামানুসারে স্যাটফোনগুলোও পরিচিত৷ ইনমারস্যাট স্যাটফোনের ডায়াল করার কোড হচ্ছে +৮৭০, +৮৭১, +৮৭২, +৮৭৩ ও + ৮৭৪৷ ইরিডিয়াম স্যাটফোনের ডায়ালিং কোড হচ্ছে +৮৮১৬ ও +৮৭১৭৷ অনেক স্যাটফোন আবার সাধারণ ডায়ালিং কোডের মাধ্যমে কাজ করে৷ এরকম একটি স্যাটফোন হচ্ছে গ্লোবাল স্টার স্যাটফোন৷


এবার স্যাটফোন হ্যান্ডসেটের খরচাপাতির কথায় আসা যাক৷ পুরনো মডেলের থুরায়া, ইরিডিয়াম এবং গ্লোবাল স্টার স্যাটফোন হ্যান্ডসেটের দাম প্রায় ২০০ ইউএস ডলার৷ আর নতুন মডেলের হ্যান্ডসেটের দাম প্রায় ১০০০ ইউএস ডলার৷ তাছাড়াও প্রতিটি কলে গড়ে প্রতি মিনিটে ৩ থেকে ১৫ ইউএস ডলার খরচ হয়৷ তবে আশার কথা, দিন দিন স্যাটফোনের খরচ কমে আসছে৷ অদূর ভবিষ্যতে এটি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই চলে আসবে বলে ধারণা করা যায়৷


হ্যাম রেডিও প্রযুক্তি


দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে রেডিও৷ রেডিওর মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে সাবধান করা যায়, অন্য কোনো মাধ্যমে এতো সহজে সাবধান করা যায় না৷ রেডিও সাধারণত তিন ধরনের৷ এগুলো হচ্ছে- অ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও, সিটিজেন রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও৷ বাংলাদেশের জন্য রেডিও ব্যবস্থা সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম৷ কারণ, এর খরচ সবচেয়ে কম৷ এবারে দেখা যাক, কোন ধরনের রেডিওর সুবিধা-অসুবিধা কী৷ অ্যামেচার রেডিও সাধারণত ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে৷ এই রেডিও যেকেউ ব্যবহার করতে পারে৷ বিভিন্ন মেসেজ বা তথ্য আদান-প্রদানে অ্যামেচার রেডিও বেশ কার্যকর৷ পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ অ্যামেচার রেডিও ব্যবহার করছে বা এর সাথে কোনোভাবে জড়িত আছে৷ অ্যামেচার রেডিও কখনই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় না৷ সারা বিশ্বে অ্যামেচার রেডিও মানুষ একান্ত প্রয়োজনে বা শখের বশে অথবা গবেষণায় ব্যবহার করে থাকে৷ অ্যামেচার রেডিওর প্রথম প্রচলন ঊনবিংশ শতাব্দীতে৷ বর্তমানে যে ধরনের অ্যামেচার রেডিও ব্যবহার করা হয়, তার প্রথম উত্পত্তি ১৯২০ সালে৷ এই ধরনের রেডিও এখনো বিভিন্ন গবেষক এবং শৌখিন জনেরাই ব্যবহার করে থাকেন৷ অ্যামেচার রেডিওর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটি গবেষণায়, শিল্পে, প্রকৌশলে এবং সামাজিক বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করা হয়েছে৷ জীবন রক্ষাকারী রেডিও হিসেবে অ্যামেচার রেডিও বহুবার আবির্ভূত হয়েছে৷ এ ধরনের রেডিও বিভিন্ন উপায়ে ট্রান্সমিশন ও রিসিভিং সম্পন্ন করে থাকে৷ ট্রান্সমিশন ও রিসিভিংয়ে একেক প্রয়োজনে একেক রেডিও ব্যান্ড ব্যবহার করে থাকে৷ এটি এফএম বা সিঙ্গেল সাইডব্যান্ড ব্যবহার করে ট্রান্সমিশন ও রিসিভিং সম্পন্ন করে থাকে৷ তথ্য আদান-প্রদানে অ্যামেচার রেডিও সোর্স কোডও ব্যবহার করে থাকে৷ আমাদের দেশে বিভিন্ন দুর্যোগে সবচেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি হয় যোগাযোগের মাধ্যম ক্ষতিগস্ত হবার কারণে৷ অ্যামেচার রেডিও সেক্ষেত্রে একটি ভালো যোগাযোগের মাধ্যম হতে পারে৷ এর খরচ কম বলে এটি স্থাপন করা যায় সহজেই৷ থানা বা ইউনিয়ন পরিষদ লেভেলে বেশ সহজেই আমরা অ্যামেচার রেডিও ব্যবহার করতে পারি৷


সিটিজেন রেডিও প্রযুক্তি


আরেক ধরনের রেডিও হচ্ছে সিটিজেন রেডিও৷ উন্নত বিশ্বে সিটিজেন রেডিও স্বল্প দূরত্বের রেডিও হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত৷ এর আরেক নাম হচ্ছে সিবি রেডিও৷ এটি এক ধরনের টু-ওয়ে সিমপ্লেক্স রেডিও৷ অনেকটা ওয়াকিটকির মতো৷ এ ধরনের রেডিওর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এর কোনো লাইসেন্স লাগে না৷ এই রেডিও যেকেউ ব্যবহার করতে পারে৷ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও এই রেডিও ব্যবহার করা যেতে পারে৷ অবশ্য আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানই সিটিজেন রেডিও ব্যবহার করছে৷ এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে বিআরটিসিসহ দেশের প্রাইভেট অনেক বাস কোম্পানিই এই রেডিও ব্যবহার করছে৷ ১৯৪৫ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই রেডিও চালু আছে৷ এই রেডিও চলে সাধারণত ইউএইচএফ ৪৬০ থেকে ৪৭০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি সীমা পর্যন্ত৷ সিবি রেডিও অনেক ধরনের হয়৷ এগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে৷ বিভিন্ন শ্রেণীর রেডিও আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করে৷ এগুলো শ্রেণী এ, শ্রেণী বি প্রভৃতি নামে পরিচিত৷ এই রেডিওগুলো ব্যান্ড হিসেবে বেছে নেয় এএম, এফএম, ও এসএসবিআই, অবশ্য দেশভেদে ব্যান্ড ও ফ্রিকোয়েন্সিরও ভেদাভেদ আছে৷ উন্নত বিশ্বের যানবাহনের ড্রাইভাররা যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় সিটিজেন রেডিও৷ যুক্তরাষ্ট্রে হাইওয়েতেও এই রেডিও ব্যবহার করা হয়৷ এই রেডিওর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এটি ছোট, বহনযোগ্য ও খুব কম পাওয়ারেও চলে৷ আগেই বলা হয়েছে, খুব কম দূরত্বে কাজ করার জন্য এই রেডিও আদর্শ মানের৷ এর সর্বোচ্চ আউটপুট হচ্ছে ১২ ওয়াট৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এই রেডিও বেশ কাজের৷


কমিউনিটি রেডিও প্রযুক্তি


কমিউনিটি রেডিও অনেকটা আমাদের সাধারণ ব্যবহারের রেডিওর মতো৷ কিন্তু এর ক্ষমতা খুব কম৷ কমিউনিটি রেডিওর একটি ট্রান্সমিশন সেন্টার থাকবে, যার কাজ হবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, খবরাখবর, বাণী ইত্যাদি প্রচার করা৷ স্থানীয় রেডিও হিসেবে এটি বেশ কার্যকর৷ আমাদের পাশের দেশ ভারতেও এখন ব্যাপকহারে কমিউনিটি রেডিও ব্যবহার হচ্ছে৷ এর সুবিধা হলো, এর ট্রান্সমিশন সেন্টারের খরচ অন্যান্য রেডিও ট্রান্সমিশন সেন্টারের তুলনায় অনেক কম৷ এটি ব্যাটারিতেও চালানো যায়৷ আমাদের দেশের জন্য এই রেডিও সবচেয়ে কার্যকর৷ দুর্যোগের কবলে এর ট্রান্সমিশন সেন্টার পড়লেও এর ব্যাটারি ও ট্রান্সমিটার নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া যায়৷


তারপর নিরাপদ স্থান থেকে আবার এর সম্প্রচার করা সম্ভব৷ অনেকটা মোবাইল রেডিও সেন্টারের মতো এর ট্রান্সমিশন সম্ভব৷ কমিউনিটি রেডিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী৷ কারণ এর খরচ কম, বহনযোগ্য৷ দুর্যোগ চলাকালীন সময়ে এই রেডিওর পুরো ইউনিটসহকারে নিকটবর্তী নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া সম্ভব৷ সেই নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাকালীন সময়ে সম্প্রচার করার প্রয়োজন হলে এই রেডিওর অ্যান্টেনা কোনো উঁচু স্থানে এমনকি বাঁ শের মাথায় লাগিয়ে দুর্যোগের সময়েও সম্প্রচার করা যেতে পারে৷ মাসিক কমপিউটার জগত্-এর অক্টোবর ২০০৬ সংখ্যায় কমিউনিটিরেডিও ও তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলন শীর্ষক একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করা হেছিল৷ সেখানে এর বিস্তারিত বিবরণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়েছিল৷


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা


বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে- জনসংখ্যা সমস্যা৷ অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে সুষ্ঠুভাবে যেকোনো ব্যবস্থাপনাই এদেশে দুষ্কর৷ তাই দুর্যোগে প্রাণহানিও অনেক বেশি হয়৷ তাই মানুষের মৃত্যুহার ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হলে সঠিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রযুক্তিরও বড় ভূমিকা রাখতে হবে৷ অন্যান্য প্রযুক্তির পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিকেও কাজে লাগাতে হবে৷ তবেই সম্ভব সঠিকভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা৷


দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় প্রথমেই আক্রান্ত এলাকা বিদ্যুত্, টেলিযোগাযোগ প্রভৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ বাংলাদেশে এই বিদ্যুত্ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে নতুন করে সংযোগ স্থাপনের সুব্যবস্থা নেই৷ আর এ সেবাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেই ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায়৷ এবারের দুর্যোগে আমাদের দুর্যোগ আক্রান্ত অঞ্চলের বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ থেকে শুরু করে আমাদের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ বিশেষ করে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক দুর্যোগপরবর্তী সময়ে কোনো সেবাই দিতে পারেনি৷ যুক্তরাষ্ট্রে যখন ক্যাটরিনা আঘাত হানলো, তখন এদের আধুনিক প্রযুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবার ফলে এরা আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি পুরনো প্রযুক্তিও ব্যবহার করেছে৷ পুরনো আমলের টেলিগ্রাফ প্রযুক্তিও এরা ব্যবহার করেছে৷ আমাদেরও শিক্ষা নিতে হবে দুর্যোগ থেকে, যাতে করে এরকম সব ধরনের প্রযুক্তির সম্মেলন ঘটানো যায়৷ তাহলে ক্ষয়ক্ষতির হার অনেকাংশে কমানো সম্ভব৷ বাংলাদেশ যেহেতু দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল তাই আমাদেরকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে, যাতে করে সঠিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির হার সবচেয়ে কম হয় সেদিকে৷


দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তিনটি পর্যায় আছে৷ এগুলো হচ্ছে- দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগের সময় ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা৷ দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা বলতে দুর্যোগের পূর্ববর্তী সময়ের ব্যবস্থাপনাকে বুঝায়৷ অর্থাত্ আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে দুর্যোগের খবর ও দুর্যোগের প্রকৃতি জেনে সম্ভাব্য ক্ষয় ক্ষতির যতটুকু কম করা যায় সেই চেষ্টা করা৷ আমাদের দেশে কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় বলে দুর্যোগ নিরূপণ করা যায়৷ ভেবে দেখুন এই প্রযুক্তিও যদি না থাকতো তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতো বেশি হতো তা ভাবাই দুষ্কর৷ এই কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তিও কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিরই অবদান৷ ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা৷ আর মানুষকে সচেতন করার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হতে পারে রেডিও, টেলিযোগাযোগ প্রভৃতি মাধ্যম৷ উন্নত বিশ্বে সংবাপত্র ও টেলিভিশন মিডিয়া সাধারণত এক্ষেত্রে বেশ ভালো ভূমিকা রাখে৷ কিন্তু আমাদের দেশে এই খাতে এখনো বেশ সমস্যা আছে৷ আমাদের দেশে সংবাদপত্রগুলোর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই৷ কিন্তু দেশের শিক্ষিতের হার বেশ কম হওয়াতে এবং মানুষের অনীহার কারণে সংবাদপত্র পাঠ করার কালচার তেমন একটা নেই৷ শহরগুলোতে মোটামুটি এই কালচার থাকলেও গ্রাম-গঞ্জের অবস্থা খুবই খারাপ৷ ক্ষয়ক্ষতির হার কমাতে হলে অবিলম্বে এই অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে৷ আর আমাদের টেলিভিশন মিডিয়া এক্ষেত্রে তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারে না৷ দুর্যোগ শুরু হবার আগেই রেডিও ও টেলিভিশন মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার চালানোর প্রয়োজন আছে৷ ব্যাপক প্রচার চালানো গেলে মানুষের মধ্যে গুজব ও ভ্রান্ত ধারণার অবকাশ অনেক কমে যাবে৷ তাছাড়া আমাদের দেশের দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের মানুষেরা বেশ সাহসী৷ ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস নিয়ে তাদের অবজ্ঞাও কম নয়৷ ক্ষয়ক্ষতির হার বাড়ে সাধারণত এসব মানুষের অবজ্ঞার কারণেও৷ রেডিও-টেলিভিশন মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার চালানো গেলে মানুষের অবজ্ঞার পরিমাণও কমে যাবে৷ এজন্য প্রতি ১৫ মিনিট পরপর বা নিয়মিত প্রচারের প্রয়োজন আছে, যা আমাদের দেশে করা হয় না৷ দুর্যোগ মোকাবেলার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সবাইকে সচেতন রাখা, যা মিডিয়ার কাজ৷ দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখতে পারে এমন সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি৷ প্রশ্ন জাগতে পারে, আমাদের দেশে এ ধরনের কাজে তথ্যপ্রযুক্তি অবহেলিত কেন? তথ্যপ্রযুক্তি অবহেলিত থাকার অনেক কারণ রয়েছে৷ অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা খুব রিলায়েবল নয়৷ কয়েকদিন পরপর আমাদের সাবমেরিন ক্যাবল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ তখন ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবার পাশাপাশি পুরো দেশ বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগবিহীন থাকে৷ তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে আমাদের সবার আগে প্রয়োজন একটি রিলায়েবল ইন্টারনেট সংযোগ৷ কিন্তু আমাদের দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাও অতটা নির্ভরযোগ্য নয়৷ তাই বর্তমান যুগে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির অনন্য অবদান ইন্টারনেটকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগাতে হবে৷ সেইসাথে তথ্যপ্রযুক্তির আরেকটি অবদান রেডিও কমিউনিকেশন ব্যবস্থাকে ভুলে গেলে চলবে না৷ কারণ, রেডিও কমিউনিকেশন হচ্ছে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম৷ বলা দরকার, দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ রেডিও ব্যবস্থার উন্নয়ন ও কমিউনিটি রেডিওর ব্যাপক প্রসার৷ এজন্য কমিউনিটি রেডিওর পাশাপাশি হ্যাম রেডিও এবং সিটিজেন রেডিওর প্রচলন ঘটাতে হবে৷ সেইসাথে আমাদের প্রচলিত রেডিও এবং এফএম রেডিওর যুগোপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে৷ এভাবেই তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে হবে৷ এভাবে ভালো দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে আশা করা যায় সঠিকভাবে দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা সম্ভব হবে৷ তাহলেই আমরা ক্ষয়ক্ষতির হার অনেক কমিয়ে আনতে পারবো৷


দুর্যোগকালীন ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পালন৷ ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানার আগেই স্থানীয় মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হবে৷ আগেই বলেছি, আমাদের যথেষ্ট সাইক্লোন শেল্টার নেই৷ আমাদের সকলেরই এ ব্যাপারে নজর দেয়া উচিত৷ আমাদের দেশে কোনো মাধ্যমই খুব বেশি নির্ভরযোগ্য নয় বলে ধরেই নিতে হবে দুর্যোগের সময় মাধ্যমগুলো কাজ করবে না৷ সাধারণত দুর্যোগের সময় সবার আগে লাইফলাইন এসেনশিয়াল বিচ্ছিন্ন হয়৷ লাইফলাইন এসেনশিয়াল বিচ্ছিন্ন হলে বেশিরভাগ মাধ্যম কাজ করবে না৷ তথ্যপ্রযুক্তি এর ব্যতিক্রম নয়৷ লাইফলাইন এসেনশিয়াল বিচ্ছিন্ন হলেও একটা মাধ্যম কাজ করতে পারে, সেটি হলো রেডিও৷ আর রেডিওর মধ্যে সবচেয়ে উপযোগী হলো কমিউনিটি রেডিও৷ আর কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচার বা রেডিও ব্যবস্থাপনায় মনে রাখতে হবে সেটি যেন সম্প্রচারিত হয় অঞ্চলভেদে আঞ্চলিক ভাষায়৷ তা না হলে সাধারণ মানুষ এর মাধ্যমে উপকৃত হবে না৷ কমিউনিটি রেডিও চালু থাকলে দুর্যোগ শুরু হবার আগেই এর ব্যাটারি ও ট্রান্সমিটার নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে৷ প্রয়োজনে সাইক্লোন শেল্টার থেকেও যেন রেডিওর সম্প্রচার চালু রাখা যায়, সে বিষয়ে সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে৷ আর দুর্যোগ চলার সময়ে যদি ইন্টারনেট চালু থাকে, তাহলে সর্বশেষ খবরাখবর সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ তাহলে দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিতরণ সহজ ও সময়োপযোগী হবে৷ দুর্যোগ সময়ে বিভিন্ন ইউনিট প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে করে দুর্যোগ শেষ হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিডিয়াগুলোর ক্ষতি পরীক্ষা করে দ্রুত যোগাযোগ মাধ্যম আবার সচল করা যায়৷ মনে রাখতে হবে, যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর ভিত্তি করেই দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হবে৷ তাই দুর্যোগ সময়ের ব্যবস্থাপনাকে মোটেও হেলাফেলা করা উচিত নয়৷


দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা বলতে দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত যোগাযোগ মাধ্যমকে পুনরায় সচল করা, ত্রাণ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাকে বুঝায়৷ এটি অনেকাংশে নির্ভর করে দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগসময়ের ব্যবস্থাপনার উপরে৷ দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনায় টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট ও রেডিওর ভূমিকা অসীম৷ বিশেষ করে কমিউনিটি রেডিওর কথা আবারো বলতে হচ্ছে৷ দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনায় যেমন স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহার করার সুযোগ আছে তেমনি দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনাতেও কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহার করা যায়৷ দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনার প্রথমাংশেই যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো ক্ষতিগ্রস্ত টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, রেডিও ব্যবস্থা পুনরায় সচল করা৷ যদি লাইফলাইন এসেনশিয়ালগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে তাহলে সেগুলোও সচল করতে হবে৷ এরপরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন করতে হবে৷ তাদের সহযোগিতায় প্রয়োজনে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে হবে৷ আর হাসপাতালগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে চিকিত্সা প্রয়োজন এমন মানুষদের জন্য দূরবর্তী হাসপাতালে নেয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে৷


আমাদের করণীয়


ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল৷ পরিবেশ দূষণসহ নানা কারণে বাংলাদেশের জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে৷ তাই দিনে দিনে এদেশের দুর্যোগপ্রবণতা বাড়ছে৷ আমাদেরকেও এর সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে৷ তা না হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই যাবে৷ এমনিতেই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশি ভালো নয়৷ তাই আমাদেরকে ভাবতে হবে, কত কম খরচে অধিক সুরক্ষা পাওয়া যায়৷ এজন্য অবিলম্বে এদেশে কমিউনিটি রেডিও কার্যকর করতে হবে৷ আমাদের আবহাওয়া ও দুর্যোগ প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ আমাদের দুর্যোগের সিগন্যালিং ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করতে হবে৷ সিগন্যালিং ব্যবস্থা বন্দরভিত্তিক না করে অঞ্চলভিত্তিক করতে হবে৷ আমরা সবাই জানি, আমাদের ৮, ৯ এবং ১০ নম্বর বিপদসঙ্কেত মোটামুটি একই অর্থ বহন করে৷ সেইসাথে দুর্যোগের প্রকৃতি নির্ণয় করেই দুর্যোগের সঙ্কেত দিতে হবে৷ তা না হলে মানুষের মধ্যে এই সঙ্কেতগুলোর গুরুত্ব থাকবে না৷ আমাদের দেশে যে সাইক্লোন হয়, সেগুলো বেশ বড় ধরনের৷ উন্নত বিশ্বের সাইক্লোন এ ধরনের নয়৷ তাই সাইক্লোনের, গতি-প্রকৃতি এবং সংজ্ঞাও সঠিকভাবে নিরূপণ করতে হবে৷ সেইসাথে পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে৷ আর মিডিয়াগুলোর উন্নয়নের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিকে আরো কার্যকর মাধ্যমে পরিণত করতে হবে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হলে বিভিন্ন দুর্যোগে এদেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো কমে যাবে৷








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।